পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে, অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহাসিক ভিতরগড় দুর্গ নগরী। এটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুর্গটি ৬ষ্ঠ শতকে পৃথু রাজা কর্তৃক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। পরবর্তীতে, ১২৫৭ সালে পাল বংশীয় শাসক মুঘিসউদ্দিন কামরূপ রাজ্য আক্রমণের সময় এটি সুলতানী শাসনের অধীনে আসে। ধারণা করা হয়, ষষ্ঠ শতকের শেষ বা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির মাটির নিচে লুকিয়ে আছে সভ্যতার ইতিহাস, স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এবং বিভিন্ন মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
ভিতরগড় দুর্গের স্থাপত্য ও বিন্যাস
প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ভিতরগড় দুর্গটি চারটি ক্ষুদ্র নগরীতে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি নগরী মাটি ও ইটের সংমিশ্রণে তৈরি উঁচু দুর্গ প্রাচীর এবং পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। পরিখাগুলোর প্রস্থ ৫০ ফুট এবং গভীরতা ছিল ১০-১৫ ফুট।
ভিতরের নগরীতে ছিল রাজপ্রাসাদ, যেখানে রাজপরিবার বসবাস করত। বাইরের নগরীর "ছিরৎল" এলাকায় সাধারণ জনগণ বসবাস করত। এছাড়াও, ভিতরগড়ে কাচারি ঘর, মন্দির এবং কয়েকটি দীঘি ছিল। গবেষকদের ধারণা, মন্দির সংলগ্ন এলাকা একসময় গৌর এবং প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অংশ ছিল।
ইতিহাসের নানা অধ্যায়
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভিতরগড়ের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্বাংশের কিছু এলাকা ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ২০০৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় দুর্গের ভেতর থেকে অষ্টম শতকের তামা ও লোহার তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী, মৃৎপাত্রের তৈজসপত্র এবং দুটি প্রাচীন মন্দিরসহ মোট ২২টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়।
ভিতরগড় দুর্গে যাতায়াত ব্যবস্থা
কিভাবে যাবেন?
বাসে:
ঢাকার শ্যামলী, গাবতলী ও মিরপুর থেকে নাবিল পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, তানযিলা ট্রাভেলস এবং বরকত ট্রাভেলসের মাধ্যমে সরাসরি পঞ্চগড়ে পৌঁছানো যায়। নন-এসি বাসের ভাড়া ১০০০-১১০০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১৩০০-১৯০০ টাকা।
ট্রেনে:
ঢাকার কমলাপুর থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, একতা ও দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনে সরাসরি পঞ্চগড় যাওয়া যায়। শ্রেণী অনুযায়ী টিকিটের মূল্য ৬৯৫ থেকে ২৩৯৮ টাকা পর্যন্ত।
পঞ্চগড় বাস টার্মিনাল থেকে তেঁতুলিয়া বা বাংলাবান্ধাগামী বাসে বোর্ড বাজার নামতে হবে। বোর্ড বাজার থেকে অটোরিকশা নিয়ে ভিতরগড় দুর্গে পৌঁছানো যায়, যার ভাড়া ২০-২৫ টাকা।
আবাসন সুবিধা
পঞ্চগড়ে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেলসমূহ হল:
- হোটেল মৌচাক
- হোটেল রাজ নগর
- হিলটন বোর্ডিং
- রোকখানা বোর্ডিং
- হোটেল প্রীতম
- হোটেল এইচ কে প্যালেস
- হোটেল ইসলাম
এছাড়া, অনুমতি সাপেক্ষে সার্কিট হাউস ও জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতেও থাকার সুযোগ রয়েছে।
খাবারের স্থান
পঞ্চগড়ে কিছু জনপ্রিয় খাবারের হোটেলের মধ্যে রয়েছে:
- হোটেল করোটিয়া
- হোটেল মৌচাক
- হোটেল নিরিবিলি
- হোটেল হাইওয়ে
- হোটেল হামজা
পঞ্চগড়ের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
ভিতরগড় দুর্গ ছাড়াও পঞ্চগড় জেলায় আরও কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে:
- বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট
- তেঁতুলিয়া
- কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন পয়েন্ট
- চা বাগান
- মহারাজার দীঘি
- রকস মিউজিয়াম
ভিতরগড় দুর্গ নগরী প্রাচীন ঐতিহ্য, স্থাপত্যশৈলী ও প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যবোধের এক অনন্য নিদর্শন। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহী ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এটি এক অসাধারণ গন্তব্য হতে পারে।
এখনো কোনো মন্তব্য নেই
প্রথম মন্তব্য করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!