ঠাকুরগাঁও জেলার অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো বালিয়া মসজিদ। লোককথা অনুযায়ী, এক অমাবস্যার রাতে কিছু জ্বীন এই এলাকায় এসে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। রাতভর তারা নির্মাণকাজ চালালেও ভোর হওয়ার আগে গম্বুজের কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। এরপর প্রায় শত বছর মসজিদটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। অবশেষে ২০০৫ সালে এর সংস্কার কাজ শুরু হয়, এবং ২০১০ সালে এটি মুসল্লিদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই রহস্যময় গল্পের কারণে স্থানীয়দের কাছে এটি "জ্বীনের মসজিদ" নামে পরিচিত।
ইতিহাসের পাতায় বালিয়া মসজিদ
ঐতিহাসিক তথ্য মতে, বালিয়ার জমিদারকন্যা গুলমতি চৌধুরানির স্বামী মেহের বক্স চৌধুরী মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দেয়ালে খোদিত শিলালিপি অনুযায়ী, ১৩১৭ বঙ্গাব্দ (১৯১০ সাল) সালে এর নির্মাণ শুরু হয়। তবে মেহের বক্স চৌধুরী একই বছরে মৃত্যুবরণ করায়, মসজিদের কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়।
স্থাপত্য শৈলী ও নির্মাণ বৈশিষ্ট্য
বালিয়া মসজিদের স্থাপত্যে মোগল আমলের ছাপ দেখা যায়। এটি একটি তিন অংশের কমপ্লেক্স — প্রধান ফটক, খোলা চত্বর, এবং মূল মসজিদ ভবন। ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত দেওয়ালের উপর নির্মিত মসজিদটি পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আয়তনের। মাটি থেকে প্রায় ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদের ছাদে রয়েছে ৩টি গম্বুজ ও ৮টি মিনার।
দেওয়ালে চুন-সুরকি, হাতে পোড়ানো ইট ও টাইল দিয়ে লাল ইট কেটে পদ্ম, কলস, ঘণ্টা, আমলকী ও ডিশ-বাটির নকশা খোদাই করা হয়েছে, যা মুগ্ধ করবে ইতিহাস ও স্থাপত্যপ্রেমীদের।
যেভাবে যাবেন বালিয়া মসজিদ
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পঞ্চগড় মহাসড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার দূরে ভুল্লিবাজার। সেখান থেকে বালিয়া গ্রাম মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে। ঠাকুরগাঁও পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস বা অটোরিকশায় ভুল্লিবাজার যাওয়া যায়। বাসভাড়া জনপ্রতি ১৫ টাকা, আর অটোরিকশা রিজার্ভ করলে খরচ পড়বে ১০০ টাকা। ভুল্লিবাজার থেকে ভ্যানে সহজেই পৌঁছে যাবেন বালিয়া মসজিদে।
ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও যাত্রা
- বাস: কর্ণফুলী, হানিফ, নাবিল, এনা, কেয়া পরিবহনের এসি/নন-এসি বাস চলাচল করে। ভাড়া ৮০০-১৮০০ টাকা।
- ট্রেন: কমলাপুর বা বিমানবন্দর থেকে একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে ঠাকুরগাঁও যাওয়া যায়। টিকেটের দাম ৬৫০-২২৩৭ টাকা।
কোথায় থাকবেন ও খাবেন
ঠাকুরগাঁওয়ে সরকারি ডাকবাংলো ও রেস্টহাউস ছাড়াও হোটেল সালাম ইন্টারন্যাশনাল, প্রাইম ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল শাহ্ জালাল, হোটেল সাদেক ইত্যাদিতে থাকতে পারেন। খাবারের জন্য স্থানীয় সাধারণ ও মাঝারি মানের হোটেল-রেস্তোরাঁ পাওয়া যাবে। তবে আমের মৌসুমে গেলে বিখ্যাত সূর্যপুরী আম খেতে ভুলবেন না!
অন্য দর্শনীয় স্থানগুলো
- মলানি গ্রাম: সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা দেখা যাবে।
- ফানসিটি শিশু পার্ক: পীরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত।
- রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি: রানীশংকৈল উপজেলায় কুলিক নদীর তীরে অবস্থিত।
- বুড়ির বাঁধ: শীতকালে এখান থেকে ভারতের কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়।
বালিয়া মসজিদ শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, এটি ঠাকুরগাঁওয়ের সংস্কৃতি, স্থাপত্য এবং লোককথার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ইতিহাসের ছোঁয়া আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই স্থান আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তাই পরবর্তী ভ্রমণ তালিকায় বালিয়া মসজিদকে জায়গা দিতে ভুলবেন না!
এখনো কোনো মন্তব্য নেই
প্রথম মন্তব্য করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!