নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ফুলবাড়ি একটি শান্ত, মনোরম গ্রাম। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় থেকে উৎসারিত গনেশ্বরী নদী এই গ্রামের বুক চিরে বয়ে গেছে। সীমান্তের এপার-ওপার জুড়ে সবুজে ঘেরা পাহাড় আর মেহগনি গাছের সারি জায়গাটিকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। এই নির্জন, প্রকৃতির কোলে শায়িত আছেন সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাদের স্মরণে স্থানটি "সাত শহীদের মাজার" নামে পরিচিত।
ঐতিহাসিক পটভূমি
১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই, নেত্রকোণার বিরিশিরি থেকে কলমাকান্দায় পাকবাহিনীর রসদ সরবরাহের খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনা করেন নাজিরপুর বাজারের আশেপাশে হামলা চালানোর। তারা বাজারের সব প্রবেশপথে অ্যামবুশ করে অপেক্ষা করতে থাকেন। নির্ধারিত সময় পার হলেও পাকবাহিনী না এলে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ তুলে নেয়ার সময় হঠাৎ শত্রুদের মুখোমুখি হন। শুরু হয় তীব্র গুলি বিনিময়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত না থাকলেও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যান। যুদ্ধ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বিকেলের দিকে পাকবাহিনী আক্রমণ আরও তীব্র করলে, মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার আহত হন, ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। শত্রুরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি করে নির্মমভাবে বেয়নেট চার্জে হত্যা করে।
সেই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন:
- জামাল উদ্দিন
- ডা. আব্দুল আজিজ
- ফজলুল হক
- ইয়ার মামুদ
- ভবতোষ চন্দ্র দাস
- নূরুজ্জামান
- দ্বীজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস
২৭ জুলাই, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ফুলবাড়িতে তাঁদের সমাহিত ও দাহ করা হয়। আজও সেই স্থান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি নেত্রকোণা আসতে পারেন। সেখান থেকে মোটরসাইকেল রিজার্ভ নিয়ে কলমাকান্দা হয়ে লেঙ্গুরা বাজার পেরিয়ে সাত শহীদের মাজারে যেতে পারবেন। নেত্রকোণা সদর থেকে লেঙ্গুরার দূরত্ব প্রায় ৫৪ কিলোমিটার। যদি বিরিশিরি ভ্রমণ করেন, সেখান থেকেও লেঙ্গুরা যেতে পারেন, যা প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে। এছাড়া ঢাকার মহাখালী থেকে কলমাকান্দা পর্যন্ত সরাসরি নাইট কোচ রয়েছে।
আশেপাশে দেখার জায়গা
লেঙ্গুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। এখানে গারো ও হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস, তাঁদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা দেখতে পারেন। গনেশ্বরী নদীর ধারে ছোট ছোট টিলা ঘুরে দেখতে পারেন, যেখানে দাঁড়িয়ে মেঘালয়ের পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। লেঙ্গুরা বাজারের কাছে গনেশ্বরী নদীর উপর একটি কাঠের ব্রিজ রয়েছে, যা দেখতে বেশ আকর্ষণীয়।
খাবার ও থাকা
লেঙ্গুরা ও কলমাকান্দার বাজারে সাধারণ মানের দেশীয় খাবারের হোটেল পাবেন। তবে থাকার জন্য আশেপাশে ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা সুবিধাজনক। প্রয়োজনে নেত্রকোণা সদরের আবাসিক হোটেলগুলোতে রাতযাপন করতে পারেন।
ফুলবাড়ি শুধু প্রকৃতির নয়, ইতিহাসেরও এক নিঃশব্দ সাক্ষী। এই জায়গায় ঘুরতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের গল্প হৃদয়ে গেঁথে আসবে, আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
এখনো কোনো মন্তব্য নেই
প্রথম মন্তব্য করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!