শালবন বৌদ্ধ বিহার কুমিল্লা জেলার কোটবাড়িতে অবস্থিত, যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন। একসময় এই অঞ্চলে শাল ও গজারির বন ছিল, সেজন্য এই বিহারকে "শালবন বিহার" বলা হয়। বিহারটির স্থাপত্য অনেকটা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মতো, তবে এটি তুলনামূলকভাবে ছোট।
আবিষ্কার ও নির্মাণ ইতিহাস
১৮৭৫ সালে কোটবাড়ি এলাকায় রাস্তা তৈরির সময় একটি ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়, যা প্রাথমিকভাবে প্রাচীন দুর্গের অংশ বলে মনে করা হয়েছিল। ১৯১৭ সালে ঢাকা জাদুঘরের অধ্যক্ষ নলিনী কান্ত ভট্টশালী এটি পর্যবেক্ষণ করে এটিকে পট্টিকেরা নগরের অংশ বলে ধারণা করেন। ধারণা করা হয়, ৭ম শতকের শেষের দিকে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এই বিহার নির্মাণ করেন। বিভিন্ন সময়ে এটি ছয়বার নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে, যার মধ্যে ৮ম ও ৯ম শতকে মূল মন্দির ও বিহারের ব্যাপক সংস্কার হয়।
স্থাপত্য ও বিন্যাস
শালবন বিহারটি আয়তাকার, যার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৬৭.৭ মিটার। চারদিকে প্রায় পাঁচ মিটার পুরু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই বিহারে মোট ১৫৫টি কক্ষ রয়েছে। এগুলো মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসবাস ও ধর্মচর্চার জন্য ব্যবহৃত হতো। বিহারের একমাত্র প্রবেশদ্বারটি উত্তর দিকে অবস্থিত। কক্ষগুলোর সামনে বারান্দা এবং পেছনে প্রাচীর রয়েছে, যেখানে প্রদীপ রাখার তিনটি করে কুলুঙ্গি দেখা যায়। এছাড়া চারটি বিশাল স্তম্ভের ওপর নির্মিত একটি হলঘর পাওয়া গেছে, যা ভিক্ষুদের খাবারের জন্য ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার
বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননে শালবন বিহার থেকে প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা, ব্রোঞ্জ ও মাটির মূর্তি, আটটি তাম্রলিপি, সিলমোহর এবং অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা পাওয়া গেছে। এসব নিদর্শনের অধিকাংশই ময়নামতি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে কুমিল্লা
বাস: ঢাকা থেকে কুমিল্লা সড়কপথে যেতে প্রায় ২.৫ ঘণ্টা সময় লাগে। ঢাকার সায়েদাবাদ ও কমলাপুর থেকে উপকূল, তিশা, স্টার লাইন, বিআরটিসি, রয়েল, এশিয়া লাইনসহ বিভিন্ন বাস সার্ভিস রয়েছে। জনপ্রতি ভাড়া ২৫০-৪০০ টাকা।
ট্রেন: ঢাকা থেকে কুমিল্লাগামী ট্রেনগুলোর মধ্যে (সুবর্ণ ও সোনার বাংলা ছাড়া) প্রায় সব ট্রেনই কুমিল্লায় থামে। জনপ্রতি ট্রেন ভাড়া ১৭০-৭০২ টাকা।
চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা
প্রিন্স বা সৌদিয়া বাসে কিংবা যে কোনো ঢাকাগামী বাসে কুমিল্লায় আসতে পারেন। এছাড়া ট্রেনে আসলে বাসের তুলনায় সময় কম লাগবে।
কুমিল্লা থেকে শালবন বিহার
লোকাল সিএনজি: কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে কোটবাড়ি লোকাল সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া ৪০ টাকা। কোটবাড়ি থেকে অটোরিকশায় ১০ টাকা ভাড়ায় শালবন বিহারে যাওয়া যায়।
রিজার্ভ সিএনজি: কুমিল্লা শহর থেকে সরাসরি কোটবাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি রিজার্ভ নিলে ২০০ টাকা খরচ হবে।
সময়সূচি
শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর
- রবিবার ও সরকারি ছুটির দিন: বন্ধ
- সোমবার: অর্ধ দিবস বন্ধ
শীতকালীন সময় (অক্টোবর-মার্চ):
- মঙ্গলবার-শনিবার: সকাল ৯টা – বিকেল ৫টা (দুপুর ১-১:৩০ বিরতি)
- শুক্রবার: সকাল ৯টা – দুপুর ১২:৩০ এবং দুপুর ২টা – বিকেল ৫টা
- সোমবার: দুপুর ২টা – বিকেল ৫টা
গ্রীষ্মকালীন সময় (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর):
- মঙ্গলবার-শনিবার: সকাল ১০টা – বিকেল ৬টা (দুপুর ১-১:৩০ বিরতি)
- শুক্রবার: সকাল ১০টা – দুপুর ১২:৩০ এবং দুপুর ২:৩০ – বিকেল ৬টা
- সোমবার: দুপুর ২:৩০ – বিকেল ৫টা
প্রবেশমূল্য
- বাংলাদেশি নাগরিক: ৩০ টাকা
- ছাত্র-ছাত্রী (ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণি): ১০ টাকা
- সার্কভুক্ত দেশের পর্যটক: ২০০ টাকা
- অন্যান্য বিদেশি পর্যটক: ৪০০ টাকা
কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান
- ময়নামতি জাদুঘর
- নব শালবন বৌদ্ধ বিহার
- রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, আনন্দ বিহার
- বার্ড, ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক, ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি, লালমাই পাহাড়, ধর্ম সাগর দিঘী
কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই
কুমিল্লার বিখ্যাত আসল মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই খেতে চাইলে আপনাকে মনোহরপুর কালী বাড়িতে যেতে হবে।
- কোটবাড়ি থেকে পাদুয়ার বাজার: জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়া
- পাদুয়ার বাজার থেকে মনোহরপুর কালী বাড়ি: রিকশাভাড়া ৩০ টাকা
- কালী বাড়ির বিপরীত পাশেই আসল মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের দোকান পাবেন।
কোথায় থাকবেন?
কুমিল্লায় বেশ কিছু মানসম্মত আবাসিক হোটেল রয়েছে, যেমন:
- উচ্চমান: কুমিল্লা ক্লাব, কুমিল্লা সিটি ক্লাব (ভাড়া ১০০০-৩০০০ টাকা)
- মাঝারি মান: হোটেল চন্দ্রিমা, হোটেল শালবন, হোটেল আবেদিন, হোটেল সোনালী, হোটেল নিদ্রাবাগ, আশীক রেস্ট হাউস, হোটেল নুরজাহান (ভাড়া ২০০-৬০০ টাকা)
কোথায় খাবেন?
কুমিল্লায় বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট রয়েছে, তাই প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো রেস্টুরেন্টে খেতে পারেন। বিশেষভাবে মাতৃভাণ্ডারের আসল রসমালাই চেখে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না!
এখনো কোনো মন্তব্য নেই
প্রথম মন্তব্য করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!