চলন বিল

বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল হিসেবে পরিচিত চলন বিল (Chalan Beel) নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। এটি মূলত ছোট-বড় অসংখ্য বিলের সমন্বয়ে গঠিত একটি জলাভূমি। বর্ষার মৌসুমে চলন বিলের রূপ হয়ে ওঠে অপরূপ—চারদিকে থইথই পানি, দ্বীপের মতো ভাসমান গ্রাম, শীতের অতিথি পাখিদের কলকাকলি, শরতে কাশবনের শুভ্রতা এবং নীল আকাশের প্রতিবিম্ব এক অনন্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।

বর্ষাকালে চলন বিল তার প্রকৃত রূপ ধারণ করে, যখন প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তবে শুষ্ক মৌসুমেও এর নান্দনিকতা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। নৌকায় ভেসে বেড়ানো কিংবা বিলের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রচুর ভ্রমণপ্রেমী এখানে আসেন।

চলন বিলের আয়তন ও নদী-সংযোগ

একসময় চলন বিলের মোট আয়তন ছিল ১৪২৪ বর্গকিলোমিটার (৫০০ বর্গমাইল), তবে বর্তমানে এটি কমে ১১৫০ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। বিলটির সঙ্গে অসংখ্য খাল ও ছোট ছোট বিল যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—

✅ পিপরূল বিল
✅ লারোর বিল
✅ ডাঙাপাড়া বিল
✅ তাজপুর বিল
✅ নিয়ালা বিল
✅ মাঝগাঁও বিল
✅ চোনমোহন বিল
✅ শাতাইল বিল
✅ দারিকুশি বিল
✅ গজনা বিল
✅ বড়বিল
✅ সোনাপাতিলা বিল
✅ ঘুঘুদহ বিল

চলন বিলকে ঘিরে বেশ কয়েকটি নদী প্রবাহিত হয়েছে, যার মধ্যে করতোয়া, আত্রাই, গুড়, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাই উল্লেখযোগ্য।

চলন বিলের জীববৈচিত্র্য

চলন বিল বাংলাদেশের অন্যতম মাছের উৎসস্থল। এখানে পাওয়া যায়—

🐟 চিতল, বোয়াল, মাগুর, কৈ, শিং, টাকি, শোল, চিংড়ি, টেংরা, কালিবাউশ, মৃগেল, রিটা, মৌসি, গজার, সরপুটি, গুজা, বাঘাইর কাঁটা, তিতপুটি সহ নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ।

প্রতি শীত মৌসুমে সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া ও হিমালয় অঞ্চল থেকে নানা প্রজাতির অতিথি পাখি আসে, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ যোগ করে।

চলন বিল ভ্রমণ – কিভাবে যাবেন?

ঢাকা থেকে বাসে চলন বিল

রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি নাটোরগামী বাসে করে কাছিকাটা নামক স্থানে নামা সবচেয়ে সুবিধাজনক। বেশ কিছু পরিবহন কোম্পানি নিয়মিত নাটোর রুটে যাতায়াত করে, যেমন—

🚌 ন্যাশনাল ট্রাভেলস
🚌 গ্রামীণ ট্রাভেলস
🚌 দেশ ট্র্যাভেলস
🚌 এভারগ্রিন ট্রান্সপোর্ট
🚌 একতা ট্রান্সপোর্ট
🚌 হানিফ এন্টারপ্রাইজ
🚌 শ্যামলী পরিবহণ

বাসের ভাড়া: ৫৫০ – ১৪০০ টাকা (এসি/নন-এসি অনুযায়ী)

কাছিকাটা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে চাচকৈর বাজার হয়ে খুবজীপুর গ্রামে পৌঁছানো যায়। নাটোর অংশের চলন বিলের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য খুবজীপুর গ্রাম অন্যতম সেরা জায়গা।

✪ বিশেষ টিপস: সময় থাকলে খুবজীপুরের চলন বিল জাদুঘর ঘুরে দেখলে চলন বিল সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারবেন।

ঢাকা থেকে ট্রেনে চলন বিল

🚆 কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে নিচের যেকোনো ট্রেনে উঠে শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশনে নামতে হবে—

🔹 ধূমকেতু এক্সপ্রেস
🔹 একতা এক্সপ্রেস
🔹 সিল্কসিটি এক্সপ্রেস
🔹 সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস
🔹 চিত্রা এক্সপ্রেস
🔹 লালমনি এক্সপ্রেস
🔹 পদ্মা এক্সপ্রেস

স্টেশন থেকে সিরাজগঞ্জ জেলা শহর মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে, এখান থেকে সহজেই চলন বিলের সিরাজগঞ্জ অংশে যাওয়া যায়।

নাটোরে থাকার ব্যবস্থা

নাটোর শহরে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। ভ্রমণকারীরা হোটেল ভিআইপি এবং হোটেল রুখসানা-তে থাকতে পারেন।

🏨 সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া: ৩০০ – ৪০০ টাকা
🏨 ডাবল কেবিন ভাড়া: ৬০০ – ৭০০ টাকা

নাটোরের খাবার – কি খাবেন?

🍛 নাটোরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে স্থানীয় সুস্বাদু খাবার উপভোগ করা যায়। এখানে রান্না করা মাছের স্বাদ অতুলনীয়।

🍤 বিশেষ আকর্ষণ:
✅ চলন বিলের তাজা মাছ
✅ রানী ভবানীর বিখ্যাত মাছের পদ
✅ নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা – নাটোরে গেলে অবশ্যই খেয়ে দেখার মতো একটি মিষ্টান্ন!

নাটোরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

চলন বিলের পাশাপাশি নাটোরের বেশ কিছু জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যেমন—

উত্তরা গণভবন
দয়ারামপুর জমিদার বাড়ি
হালতি বিল
লালপুরের পদ্মার চর
বুধপাড়া কালীমন্দির
ধরাইল জমিদার বাড়ি

শেষ কথা

বাংলাদেশের প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য চলন বিল এক অনন্য ভ্রমণ গন্তব্য। নৌভ্রমণ, অতিথি পাখি দেখা কিংবা প্রকৃতির নিস্তব্ধতার মাঝে হারিয়ে যেতে চাইলে এটি হতে পারে আপনার জন্য পারফেক্ট জায়গা। বর্ষাকালে ভরা জলরাশির চলন বিল যেমন মোহিত করে, তেমনি শীতের সকালে কুয়াশা মাখা বিলের পরিবেশও চমৎকার এক অনুভূতি দেয়।