
বালি, ইন্দোনেশিয়ার এক ছোট্ট দ্বীপ, যা তার মনোরম সৈকত এবং স্বচ্ছ নীল জলর জন্য বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ। অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা, কম খরচে যাতায়াত এবং অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে আজকাল বালিতে পর্যটকদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যদিও ইন্দোনেশিয়া একটি মুসলিম দেশ, বালিতে মুসলিম জনগোষ্ঠী খুবই কম। আমাদের অতিথি লেখক শফিকুর রহমান সম্প্রতি বালি ভ্রমণ করেছেন এবং তার সেখানের অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন। এই ভ্রমণ কাহিনীতে পাবেন বালির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান, হোটেল ও রিসোর্টের বিবরণ, আনুমানিক খরচ এবং বালি ভ্রমণের জন্য দরকারি বেশ কিছু মূল্যবান টিপস।
যাত্রা
আমরা এয়ার এশিয়ার ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর থেকে সরাসরি বালি গিয়েছিলাম। এয়ার এশিয়া সরাসরি বালির জন্য সুবিধাজনক হওয়ায় কুয়ালালামপুরে ট্রানজিটে অপ্রয়োজনীয় সময় কাটাতে হয়নি। ঢাকা থেকে মালিন্দ এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে কুয়ালালামপুর হয়ে বালিতে যাওয়া তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী খরচের। আর ফেরত আসার জন্য আমরা মালিন্দ এয়ারলাইন্সই ব্যবহার করেছি।
ইমিগ্রেশন
ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়াটা বেশ সহজ। পাসপোর্ট আর রিটার্ন টিকেট দেখালে সরাসরি সীল দিয়ে দেয়া হয়। মাঝে মাঝে তারা হোটেলের রিজার্ভেশন চায়। আর ভিসার জন্য কোনো ফি দিতে হয় না।
এয়ারপোর্ট হতে হোটেল
অনলাইনে আগোডা সহ নানা প্ল্যাটফর্ম আছে যেগুলো দিয়ে আপনি আগাম গাড়ি বুক করতে পারেন। হোটেলে যোগাযোগ করলেই তারা গাড়ি পাঠাতে পারে অথবা এয়ারপোর্ট থেকে লোকাল ট্যাক্সি নিতে পারবেন। যদি একা সফর করেন বা লাগেজ কম থাকে, তাহলে সবচেয়ে সুবিধাজনক হবে মেইন এয়ারপোর্টের বাইরের পার্কিংয়ে গিয়ে গ্রাব ব্যবহার করা, কারণ এটি সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিকল্প। এয়ারপোর্ট থেকে কুটা যাওয়ার জন্য গ্রাব ভাড়া প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ ইন্দোনেশিয়ান রুপি হবে, আর লোকাল ট্যাক্সি খরচ পড়বে প্রায় ১.৫ থেকে ২ লাখ রুপি। যদি হোটেল থেকে গাড়ি পাঠানোর অনুরোধ করেন, তাহলে খরচ দাঁড়াবে প্রায় ২.৫ লাখ রুপি।
নতুন সীম কিনা
টেলকমসেল সিম মূলত পর্যটকরা ব্যবহার করে থাকেন। সিমের দাম প্রতিটি স্থানে ভিন্ন হতে পারে। বেসিক কোনো ব্যালেন্স ছাড়াই এই সিমটির আসল দাম মাত্র ১০,০০০ ইন্দোনেশিয়ান রুপি। কিন্তু সাধারণত সিম কিনলে আপনি একটু বেশি খরচ করবেন, কারণ ৬ জিবি ইন্টারনেটসহ সিমটির দাম প্রায় ১ থেকে ২.৫ লাখ রুপি পর্যন্ত উঠতে পারে। তাই সাবধান থাকা ভালো।
হোটেল বুকিং
আগোডা থেকে প্রায় দুই মাস আগে বুকিং করেছিলাম, নন-রিফান্ডেবল টাইপ, ব্রেকফাস্ট সহ। এই কারণে অনেক কম খরচ হয়েছে। যদি যাওয়ার তারিখ নিশ্চিত না হয়, তাহলে ফ্রি ক্যানসেলেশন অপশন নেওয়াই ভালো। কুটা হলো বালির সেন্টারে থাকা একটি জনপ্রিয় এলাকা। অনেকেই নুসা দুয়া, সেমিনিয়াক বা উবুদ এলাকায় থাকেন, আবার কেউ কেউ ২-৩ দিনের পর পর জায়গা পরিবর্তন করেন। থাকার ভাড়া জায়গা ও মানের উপর নির্ভর করে; কুটা এলাকায় দিনে প্রায় ২৫ ইউএস ডলারে মানসম্মত ডাবল রুম পাওয়া যায়। বেশিরভাগ হোটেল বা রিসোর্টে সুইমিং পুল থাকে, আর অনেক রিসোর্টে প্রাইভেট সি-বিচ সুবিধাও রয়েছে।
মানি এক্সচেঞ্জ
মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে রেটের অনেক পার্থক্য থাকে। আমি ১ মার্কিন ডলারের জন্য কখনো ১৩ হাজার, আবার কখনো ১৪ হাজার ৯০০ টাকার রেটও দেখেছি। তাই লোভে ভূল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার নেই। সবসময় শুধু অথরাইজড মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ভাঙ্গানো উচিত, যদিও রেট কিছুটা কমই হোক। বর্তমানে ১ ডলারের মূল্য প্রায় ১৩,৮৭৫ ইন্দো রুপি, যা সেরা এবং নিরাপদ রেট। ভুল জায়গায় গেলে সহজেই প্রতারণার শিকার হতে পারেন, যার ফলে আপনার টাকা হারানোর ঝুঁকি থাকে। উল্লেখ্য, ১ ইন্দো রুপি সমান প্রায় ০.০০৬১ টাকা। সতর্ক থাকুন, আর সঠিক জায়গা থেকেই লেনদেন করুন।
বালিতে যা দেখবেন
কুটা বিচ
বালিতে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সি বিচের সৌন্দর্য উপভোগ করা। তাই আমরা বালির বিভিন্ন বিচ ঘুরে দেখেছি, আর কুটা বিচ ছিল সবচেয়ে বড় একটি। এটি আমাদের দেশের কক্সবাজারের বিচের মতোই দীর্ঘতম। বিচের ধারে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত রেস্টুরেন্টও রয়েছে, যার মধ্যে Oceans 27 Beach Club & Grill বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিচের বালিতে প্রচুর প্রবালের ছোট ছোট টুকরো ছড়িয়ে আছে, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পানির গুণমান বালুমিশ্রিত হলেও বেশ ভালোই লাগবে। এক দুপুর কিংবা বিকেল এখানে কাটিয়ে দিয়ে সুর্যাস্ত উপভোগ করার জন্য কুটা বিচ দারুণ একটি স্থান।
নুসা দুয়া বিচ
কুটা থেকে সহজেই বাইক বা ট্যাক্সিতে পৌঁছানো যায়। এটি একটি দীর্ঘ বিচ, নুসা দুয়া থেকে শুরু করে অয়োদ্ধা পর্যন্ত বিস্তৃত। বিচের পানি কিছুটা ময়লা এবং ঘাস মিশ্রিত থাকলেও এখানকার পরিবেশ স্বতন্ত্র। বালির গঠন মোটা এবং ধারালো, আর প্রবাল ও ভাঙ্গা শামুক-ঝিনুকের ভিড় চোখে পড়ে। যদিও সামান্য অসুবিধে ছিল, তবুও এই বিচটি আমাদের খুব ভালো লেগেছে। আমরা কুটা থেকে নুসা দুয়া বিচের গ্রিল ক্লাবে গিয়েছিলাম, যেখানে প্রবেশের জন্য ৫,০০০ রুপি দিতে হয়। সেখানে আমরা রিসোর্টের সুইমিং পুলে সময় কাটিয়েছি এবং পরে গ্রিল ক্লাবে সুস্বাদু লাঞ্চ উপভোগ করেছি। এরপর বিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অয়োদ্ধা পাবলিক বিচে পৌঁছলাম। কাছেই গোজেক ট্যাক্সিতে একটু দূরত্বে ওয়াটার ব্লোও আছে, যা দর্শনীয়।
ওয়াটার ব্লো
সাগরের তীর ধরে পানির ঢেউ এত প্রবল আছড়ে পড়ে যে, তার পানির ফোয়ারা দূরদূরান্তে ছিটকে পড়ে। এই দৃশ্যের সঙ্গে প্রাকৃতিক রঙধনুর খেলা চোখে পড়ে, যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এটি একটি বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র, যেখানে প্রবেশ ফি নেই। যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর জন্য এটি অবশ্যই দেখার মতো স্থান। নুসা দুয়া ওয়াটার ব্লো একদিনের ট্যুরে খুব সহজেই অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
সুলুবান বিচ
সুলুবান বিচ এবং উলুউটু টেম্পল একসাথে এক দিনে ঘুরে দেখা যায়। এটা একটু গোপন এবং কম পরিচিত জায়গা, তাই অনেকেই এটাকে “হিডেন বিচ” বলেই ডাকে। এখানে পৌঁছাতে হলে অবশ্য পায়ে হেঁটে নামতে হবে কারণ নিচে নামার জন্য অনেক ভাঙ্গা সিঁড়ি পেরোতে হয়। নিচে নামলেই দুই পাশের পাহাড়ের মাঝে সুন্দর একটি বালুচর দেখা যায়। সামান্য হাঁটলেই খাঁজ কাটা পাহাড়ের মধ্যে এই বিচের অপরূপ সৌন্দর্য চোখে পড়ে। সাগরের পানি খুবই স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার। বিচটি ছোট হলেও এখানে প্রচুর প্রবাল ও শামুকের ভাঙা টুকরা থাকায় হাঁটা একটু অসুবিধাজনক হতে পারে। তবুও এই বিচের রহস্যময় সৌন্দর্যের সামনে এসব কিছু তুচ্ছ মনে হবে। এখানে সাঁতার কাটা এবং সাগরে নামা একদম প্রয়োজনীয়। সুলুবান বিচে অনেকেই সার্ফিং উপভোগ করে থাকেন। বিচের কাছেই সুইমিংপুলসহ “ডেলপি ক্যাফে” রয়েছে, তবে খাবারের দাম একটু বেশি। তবে বেশিরভাগ পর্যটক উপরের দিকে না গিয়ে সরাসরি নিচে নামেই বিচে চলে যায়।
প্যাডাং প্যাডাং বিচ
সুলুবান বিচ থেকে মাত্র ২০-২৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত এই বিচটি সত্যিই অনন্য। প্রবেশের জন্য কিছু ফি আছে, বয়স্কদের জন্য ১৫ হাজার রুপি এবং শিশুদের জন্য ১০ হাজার রুপি। এখানে পরিষ্কার ও আরামদায়ক ওয়াশরুম সুবিধা পাওয়া যায়, যা সাগরের পানিতে নামার পর খুবই কাজে লাগে। প্যাডাং প্যাডাং ছোট্ট হলেও দারুণ সুন্দর একটি বিচ। মূল বিচে যেতে একটু সিঁড়ি নামতে হয়, কিন্তু সেখানে পৌঁছে আপনি দেখতে পাবেন স্বচ্ছ পানি, কম ঢেউ আর অনেকদূর হাঁটতে পারবেন সাগরের ঢেউয়ে ভিজে। যদিও বিচের পাশের বালিতে কিছু প্রবাল ও শামুকের ভাঙা টুকরো থাকায় হেঁটে যেতে একটু সাবধানতা দরকার, তবে এই সামান্য অসুবিধা বিচের অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে খুব সামান্য। এখানে সারি সারি বিচ আমব্রেলা আর সান বেডও আছে, যা ভাড়া প্রায় ২ থেকে ২.৫ লাখ রুপি। প্যাডাং প্যাডাং বিচটি সত্যিই একটি চমৎকার গন্তব্য, যাকে বলা চলে বালি দ্বীপের অন্যতম সেরা বিচ।
জিম্বারান বিচ
জিম্বারান বিচ একদম দীর্ঘ ও মনোমুগ্ধকর এক সমুদ্রতীর। এখানে সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে বিচ ছাতা আর আরামদায়ক চেয়ার। পাড়ের পাশেই রয়েছে নানা রকম সি ফুড রেস্টুরেন্টের ভিড়। বিচের উপরেই বড় বড় টেবিল আর চেয়ারে বসে উপভোগ করা যায় সতেজ সি ফুড। সমুদ্রের জলে একটু বালি মেশানো থাকলেও, এই বিচ সেরা সুর্যাস্ত দর্শনের জন্য বিখ্যাত। আমরা সুর্যাস্তের আগেই এসে একটি ভালো টেবিল ঠিক করে ফেললাম। অপরূপ সেই সুর্যাস্তের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে সি ফুড অর্ডার দিলাম। দাম সাধারণত আইটেমের উপর নির্ভর করে প্রায় ৫ থেকে ১০ লাখ ইন্দোনেশিয়ান রুপি পর্যন্ত হয়। প্রতি টেবিলেই জ্বলছিল একটি কাঁচের ঘেরা মোমবাতি, আর সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন আর হালকা হাওয়ার স্পর্শে তৈরি হচ্ছিল এক দারুণ আবহ। হঠাৎ করে একদল স্থানীয় সঙ্গীতশিল্পী এলেন, এবং তারা বাজালেন মনোমুগ্ধকর লাইভ লোকাল গান। ঐ মুহূর্তগুলো ছিল একদম স্বপ্নময়; সময় কাটতে কেটে যাওয়ার টাকটাক আওয়াজই যেন শুনতে পেলাম না। পুরো অভিজ্ঞতাটি ছিল একান্ত অনন্য এবং স্মরণীয়।
সানুর বিচ
সানুর বিচ একদম পরিষ্কার ও শান্ত, পর্যটকদের জন্য আদর্শ জায়গা যেখানে ভীড়ের চিন্তা নেই। এখানে সূর্যাস্তের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর, তবে সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতাই সত্যিই অন্যরকম। চারপাশে অনেক বার আর রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেখানে স্বাদে ও পরিবেশে মুগ্ধ হওয়া যায়। এ জায়গাটিই সানুর পোর্টের অবস্থান, যেখান থেকে নুসা পেনিদা এবং গিলি গিলি আইল্যান্ডে যাওয়া সহজলভ্য।
নুসা লেম্বুগান
নুসা লেম্বুগান এবং নুসা পেনিদা একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। একই দিনে দুটোই ভ্রমণ করা সম্ভব, তবে এতে শরীরের উপর চাপ কিছুটা বেশি পড়তে পারে। তাই যদি পরিকল্পনা করেন, নুসা পেনিদায় অন্তত একদিন থাকা উত্তম। নুসা পেনিদাও সত্যিই মনোমুগ্ধকর একটি গন্তব্য। এখানে জনপ্রিয় পর্যটন স্থলগুলো হলো: ডেভিলস টিয়ার, ড্রিম বিচ, ইয়োলো ব্রিজ এবং মাশরুম বে। এখানকার পানিও একদম স্বচ্ছ ও নীলাভ, যা দর্শনীয় অভিজ্ঞতা দেয়। সুযোগ থাকলে দুটো জায়গাই দেখার চেষ্টা করা উচিত।
গিলি গিলি আইল্যান্ড
বালি থেকে একটু দূরে অবস্থিত এই স্থানে যেতে চাইলে সময় থাকতে হবে। এখানে তিনটি ছোট দ্বীপ—Gili Trawangan, Gili Meno, এবং Gili Air Island—আছে। তবে সময়, খরচ এবং দূরত্ব বিবেচনা করলে গিলির বদলে নুসা পেনিদা বা লেম্বুগান অথবা দুটোই একসাথে ভ্রমণ করা অনেক বেশি সুবিধাজনক ও রekomেন্ড করা হয়।
উপসংহার
ইন্দোনেশিয়ার বালি টুর প্ল্যান করতে চাইলে প্রথমেই আপনার সময় এবং বাজেট ঠিক করে নিন। বালির মূল আকর্ষণগুলো যেমন কুটা, উবুদ, নুসা পেনিদা এবং লেম্বুগান দ্বীপগুলোকে প্রাধান্য দিন। গিলি দ্বীপগুলো দূরত্ব এবং খরচের কারণে সময় মত পরিকল্পনা করতে হবে। ভালো রিসোর্ট ও সুলভ খাবারের ব্যবস্থা খুঁজে নিন, আর স্থানীয় সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মজাই নিন। পর্যাপ্ত সময় দিয়ে প্ল্যান করলে বালি আপনার জন্য এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
মন্তব্য