
বিস্তৃত জলরাশির মাঝখানে হিজল আর করচ গাছের সারি, পাখিদের মুক্ত উড়ান, আর দূরে মেঘালয়ের পাহাড়ের প্রান্তর মিলে এক মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি হয়। নীল জল, পাহাড় আর মেঘের এ অনবদ্য মিলন দেখতে প্রতি বছর হাজারো পর্যটক টাঙ্গুয়ার হাওরে ছুটে আসে, শান্তি আর রোমাঞ্চের সন্ধানে। চলুন জানি টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের পরিকল্পনা (tanguar haor tour plan), যা আপনার যাত্রাকে আরও সুন্দর ও আরামদায়ক করবে।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের আগে যা জানা জরুরি
টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার ৫১টি জলমহাল নিয়ে গঠিত। এই বিশাল হাওরের আয়তন ৬,৯১২.২০ একর, যা বর্ষাকালে বেড়ে প্রায় ২০,০০০ একরে পৌঁছে। বর্ষাকালই টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখার সেরা সময়। তখন হাউজবোটে চড়ে পুরো হাওরটা সহজেই দেখা যায় এবং প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
আজকের আধুনিক হাউজবোটগুলো নানা ধরনের সুবিধায় সজ্জিত। বেড, হাই কমোডযুক্ত টয়লেট, এয়ার কন্ডিশন ও ফ্যান, ২৪ ঘণ্টা জেনারেটর, মোবাইল চার্জিং সুবিধা, তিন বেলা খাবার, চা-কফি, স্ন্যাকস সবই থাকে। সুবিধার ওপর ভিত্তি করে হাউজবোটের ভাড়া নির্ধারিত হয়, যা জনপ্রতি ৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে হয়। প্রতি হাউজবোটে সাধারণত ৪ থেকে ৫টি রুম থাকে, এক রুমে ২ থেকে ৩ জন থাকতে পারে, কিছু রুমে ৪-৫ জনও থাকা যায়।
এই প্যাকেজে হাওরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা, রাত যাপন ও খাবার সবই অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাই আপনাকে কিছু করার দরকার নেই। টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের সবচেয়ে সহজ ও আরামদায়ক উপায় হলো ভালো কোনো হাউজবোটের প্যাকেজ নেয়া। এককভাবে না এসে ১০-১৫ জনের টিম নিয়ে গেলে ভালো হয়, এতে পুরো হাউজবোট শুধু আপনার দলের জন্যই থাকে। তবে টিম না পেলে একাকেও আসতে পারেন।
অনেক হাউজবোটের ফেসবুক পেজ রয়েছে, আগেই বুকিং করে আসা ভালো। জলকুমারী হাউজবোট সার্ভিসেস অন্যতম পরিচিত সার্ভিস। বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিও টাঙ্গুয়ার হাওরের প্যাকেজ অফার করে থাকে।
টাঙ্গুয়ার হাওর ট্যুর প্ল্যান
হাওরের আশেপাশে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা না দেখলে ট্যুর অসম্পূর্ণ মনে হবে। তবে সেগুলো দেখতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। সঠিক পরিকল্পনায় মাত্র দুই দিন এক রাতে সব জায়গা ঘুরে দেখা সম্ভব। ২ দিন ১ রাতের প্ল্যানটি মোটামুটি এরকম:
প্রথম দিন:
ঢাকা থেকে রাতের বাসে সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছবেন। শহরের সুরমা নদীর তীরে অনেক ঘাট আছে, যেখান থেকে হাউজবোট ভাড়া পাওয়া যায়। আগে থেকে বুকিং থাকলে অটো বা হেঁটে বোটে যাবেন। না থাকলে ঘাট থেকে দরদাম করে বোট ভাড়া নিন। ছোট টিম হলে অন্যদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। বাজার নিজেই করে নিতে হতে পারে, তাই ২ দিনের খাবারের জিনিসপত্র আগে থেকে কিনে নিন। বোটে বাবুর্চি থাকে রান্নার জন্য।
হাউজবোট যেন সকালে দ্রুত ছেড়ে যায় তা নিশ্চিত করুন, কারণ প্রতিদিন অনেক বোট চলাচল করে, ভিড় এড়াতে সকালেই রওনা দেওয়াই ভালো।
বোটে উঠে ছাদে বসবেন, সুরমা নদীর ধারে হাওরের দিকে বোট চলবে। ছাদে বসে চা খেতে খেতে সকালের নাস্তা পরিবেশন করা হবে, সাধারণত খিচুড়ি, ডিম আর বেগুন ভাজি থাকে।
জিরো পয়েন্ট:
প্রথম গন্তব্য জিরো পয়েন্ট, যেখানে ওয়াচ টাওয়ার ও অর্ধ নিমগ্ন হিজল-করচ গাছের বন আছে। এখানেই সবাই সাধারণত হাওরের পানিতে গোসল করে। নামার আগে অবশ্য লাইফ জ্যাকেট পরে নেবেন। সাঁতার না জানলে ছোট নৌকায় চারপাশ ঘুরে দেখতে পারেন, মাঝিরা গান গেয়ে মজা দেবেন।
নীলাদ্রি লেক:
প্রায় এক ঘণ্টা থাকার পর নীলাদ্রি লেকে যাবেন। পথে দুপুরের খাবার নিবেন। বিকেলে লেকের চারপাশ পায়ে হেঁটে ঘুরবেন, ছবি তুলবেন। এখানে কায়াকিং বা নৌকায় ঘোরাঘুরি করা যায়। অধিকাংশ হাউজবোট রাতে এখানেই থাকে। তবে চাইলে মাঝিকে বললে বারেকের টিলায় যেতে পারবেন, যা রাতে বেশি শান্ত ও উপভোগ্য।
যাদুকাটা নদী:
বারেকের টিলার পাশেই যাদুকাটা নদীর তীরে হাউজবোট ভিড়াতে পারেন, এখানেই রাত কাটাবেন। নদীর নীল জল আর বালি-পাথরের প্রান্তর দেখতে পারবেন। স্থানীয়রা বালি-নুড়ি সংগ্রহ করে বিক্রি করে।
দ্বিতীয় দিন:
সকালে উঠে বারেকের টিলা ঘুরে আবার পূর্বের জায়গায় আসবেন। সকালের নাস্তা খাবেন। এরপর যাদুকাটা নদীতে সাঁতার কাটবেন। নদীর স্বচ্ছ ও ঠাণ্ডা পানি ভ্রমণকে মধুর করবে।
শিমুল বাগান:
নদী থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে শিমুল বাগানে যাবেন। প্রবেশের জন্য ৫০ টাকা টিকেট লাগে। বর্ষাকালে বাগান সবুজে ভরপুর থাকে। এখান থেকে যাদুকাটা নদীর দৃষ্টিনন্দন ভিউ পাওয়া যায়, যা ছবি তোলার জন্য দারুণ জায়গা।
শিমুল বাগান থেকে ফিরে সুনামগঞ্জ শহরের পথে হাঁটবেন। পথে দুপুরের খাবার খাবেন। যদি গরম লাগে, হাওরের পানিতে গোসল করে শরীর ঠাণ্ডা করতে পারেন। সন্ধ্যায় হাউজবোট সুনামগঞ্জে ফিরে আসবে। বোট থেকে নেমে রাতের বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন।
মন্তব্য