পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, যা সোমপুর মহাবিহার নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত, যা জেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। পাল রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল ৯ম শতকে এই মহাবিহারটি নির্মাণ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক আবিষ্কার ও গুরুত্ব
১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার কানিংহাম প্রথম এই স্থানটি আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে, ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। প্রায় ৩০০ বছর ধরে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল, যেখানে তিব্বত, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মায়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধর্মচর্চা ও জ্ঞানার্জনের জন্য আসতেন।
স্থাপত্য ও বিন্যাস
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার প্রায় ৯২২ ফুট লম্বা ও ৯১৯ ফুট প্রশস্ত আয়তনের একটি বিশাল স্থাপনা। এতে ১৭৭টি কক্ষ ছিল, যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন। বিহারের কেন্দ্রে অবস্থিত মন্দিরটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু, যার দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট ও প্রস্থ ৩৫০ ফুট। এর বাইরের দেয়ালে পোড়া মাটির ফলকে খোদাই করা বুদ্ধ ও বিভিন্ন দেব-দেবীর চিত্র পাওয়া যায়। মূল বেষ্টনী প্রায় ২০ ফুট চওড়া এবং এর অভ্যন্তরে আরও একটি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে।
বিহারের চারপাশে একটি চওড়া সীমানা প্রাচীর ছিল, যার ভেতরে ৯২টি ছোট ছোট কক্ষ সারিবদ্ধভাবে নির্মিত হয়েছিল। এসব কক্ষ ভিক্ষুদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তবে পরবর্তীতে কিছু কক্ষকে প্রার্থনার জন্যও ব্যবহৃত হয় বলে ধারণা করা হয়। বিহারের উত্তর দিকে প্রধান প্রবেশপথ অবস্থিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান
১৯৮৪-৮৫ সালের খননকালে এখানে খলিফা হারুন আল রশিদের শাসনামলের বেশ কিছু রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া যায়, যা বর্তমানে পাহাড়পুর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও মুদ্রা, শিলালিপি ও বিভিন্ন দেবীমূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের দর্শনীয় স্থান
কেন্দ্রীয় মন্দির
এই মন্দিরের দেয়ালে প্রায় ২০০০টি পোড়ামাটির ফলকচিত্র রয়েছে, যা তৎকালীন শিল্প ও সংস্কৃতির অপূর্ব নিদর্শন।
স্নানাগার ও শৌচাগার
বিহারের বাইরে দক্ষিণ দেয়ালের কাছে অবস্থিত এই স্থাপনা ১০২ নম্বর কক্ষের সাথে সংযুক্ত ছিল।
সন্ধ্যাবতীর ঘাট
বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত এই ঘাটটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে রাজকুমারী সন্ধ্যাবতী স্নান করতেন বলে কথিত আছে।
উন্মুক্ত অঙ্গন
এখানে প্রশাসনিক ভবন, ভোজনশালা, রান্নাঘর, কুয়ো ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
সত্যপীরের ভিটা
বিহারের ৩৬৫ মিটার পূর্বে অবস্থিত এই স্থানে ১৩২টি নিবেদন স্তূপ ও পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে।
গন্ধেশ্বরী মন্দির
সন্ধ্যাবতী ঘাটের পাশে অবস্থিত এই মন্দিরে বৌদ্ধদেবী পদ্মপাণির মূর্তি রয়েছে এবং মন্দিরের দেয়ালে পদ্মফুলের নকশা খোদাই করা আছে।
ভ্রমণের সময়সূচী
- এপ্রিল-সেপ্টেম্বর: সকাল ১০টা - বিকেল ৬টা (সোমবার ২:৩০ - ৬টা)
- অক্টোবর-মার্চ: সকাল ৯টা - বিকেল ৫টা (সোমবার ১:৩০ - ৫টা)
- প্রতি রবিবার: সম্পূর্ণ বন্ধ
- সরকারি ছুটির দিন: বন্ধ
কিভাবে যাবেন?
- বাসে: নওগাঁ জেলার বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে ৪০-৫০ টাকা ভাড়ায় সরাসরি পাহাড়পুরে পৌঁছানো যায়।
- ট্রেনে: সান্তাহার বা জয়পুরহাট হয়ে জামালগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে নেমে ভ্যান বা অটোরিকশায় ৫ কিমি দূরত্বে পাহাড়পুরে যাওয়া যায়।
কোথায় খাবেন?
বিহারের প্রবেশপথের সামনে কিছু খাবারের দোকান রয়েছে। তবে বিহারের ভেতরে খাবার গ্রহণের অনুমতি নেই।
কোথায় থাকবেন?
পাহাড়পুরে রাতযাপনের তেমন ব্যবস্থা নেই। তবে নওগাঁ জেলা সদরে বা জয়পুরহাটে থাকা সম্ভব।
নওগাঁর কিছু আবাসিক হোটেল:
- হোটেল মল্লিকা ইন
- হোটেল অবকাশ
- হোটেল যমুনা
- হোটেল রাজ
- মোটেল চিসতী
এই প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থানটি ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা দিতে পারে।
এখনো কোনো মন্তব্য নেই
প্রথম মন্তব্য করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!