
মনের খোরাক মেটাতে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো অনেকের কাছে একটি জীবনের বড় আনন্দের উৎস। তবে সমস্যা দেখা দেয় যখন পকেটের আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গে ভ্রমণের খরচ মেলাতে পারে না। অনেকেই ভাবেন ভ্রমণ মানেই বেশি খরচ, কিন্তু আসলে কিছু ছোট ছোট কৌশল মেনে চললে দেশের ভিতর বা বাইরে ভ্রমণের খরচ কমিয়ে আনা যায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। চলুন জেনে নিই কিছু কার্যকর কৌশল, যা অনুসরণ করলে ভ্রমণ হবে অনেক সাশ্রয়ী ও স্মরণীয়।
১. দলীয়ভাবে ভ্রমণ করার পরিকল্পনা করুন
যেকোনো স্থানে যাওয়ার সময় দল বেঁধে ভ্রমণ করার চেষ্টা করুন। এতে খরচ কমানোর পাশাপাশি ভ্রমণের আনন্দও দ্বিগুণ হয়। পাশাপাশি, নিরাপত্তার দিক থেকেও এটি অনেক বেশি সুবিধাজনক। ধরুন, সাজেক বা লালাখালে ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন। একা গেলে যানবাহনের ভাড়া বেশি পড়বে এবং ব্যবস্থা করাও কঠিন হবে। কিন্তু চার থেকে আট জনের একটি গ্রুপে গেলে জনপ্রতি খরচ অনেক কমে যায় এবং যাত্রা আরও মসৃণ হয়।
দলগত ভ্রমণ শুধু অর্থ সাশ্রয় করে না, বরং মজাও দ্বিগুণ করে তোলে। তাই পরবর্তী ভ্রমণের পরিকল্পনায় দলীয় ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিন।
হোটেল বুকিং এর কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ
২. অফ-পিক সিজনে ভ্রমণ করুন
দেশ হোক বা বিদেশ, জনপ্রিয় ভ্রমণস্থলগুলোর পিক সিজনে গেলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। যেমন, কক্সবাজারের একটি সাধারণ হোটেলের রুম সাধারণ সময় ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকায় পাওয়া গেলেও উৎসবের সময় বা বড় ছুটির দিনে তা বেড়ে যায় ২০০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। পিক সিজনে পর্যটকদের ভীড় বেড়ে যায়, তাই টিকেট, থাকার জায়গা ও অন্যান্য সুবিধার দামও বাড়ে।
অন্যদিকে, অফ-পিক সিজনে গেলে পর্যটকদের চাপ কম থাকে, ফলে খরচ অনেকটাই কমে আসে। তাই ব্যক্তিগত ছুটি থাকলে এই সময়গুলো কাজে লাগিয়ে ভ্রমণ করলে বাজেট অনেক হ্রাস পায়।
৩. নিজেরা সব আয়োজন করুন
আজকাল অনেক ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে যারা বাস, ট্রেন, প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং, খাবার-দাবার ও অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেয়। যদিও এতে ঝামেলা কম হয়, কিন্তু এজেন্সিগুলো সাধারণত প্রতিটি সেবা থেকে কমিশন পায়। ফলে তারা আপনার বাজেটের চেয়ে নিজেদের সুবিধাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
অতএব, সব আয়োজন নিজে নিজে করার চেষ্টা করলে অনেক খরচ বাঁচানো সম্ভব। নিজেরা দরাদাম করে টিকেট, হোটেল বুকিং এবং অন্যান্য যাবতীয় ব্যবস্থা করলে বাজেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়ানো যায়।
৪. পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করুন
ভ্রমণের সবচেয়ে বড় খরচগুলোর একটি হল যাতায়াতের খরচ। এই ক্ষেত্রে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করা সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপায়। লোকাল বাস, ট্রেন কিংবা রিকশা সাধারণত ট্যাক্সি বা প্রাইভেট কারের তুলনায় অনেক কম খরচে চলাচল করে। যেখানে যেখানে ঘুরতে যান, সেখানের স্থানীয় যানবাহন যেমন অটোরিকশা, ইজিবাইক, সিএনজি ইত্যাদি ব্যবহার করে অল্প খরচে নিরাপদ ভ্রমণ করতে পারবেন।
বিদেশের অনেক জায়গায় পর্যটকদের জন্য বিশেষ ট্রান্সপোর্ট পাস পাওয়া যায়, যেমন এক দিনের আনলিমিটেড বাস বা ট্রেন পাস, যা ব্যয়বহুল পরিবহনের বিকল্প হিসেবে খুবই কার্যকর।
৫. প্রি-প্ল্যান ও প্রি-বুকিং করুন
ভ্রমণের আগে গন্তব্য সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ খবর নেয়া এবং একটি স্পষ্ট প্ল্যান তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। এতে খরচের একটা ধারণা পাওয়া যায় এবং অহেতুক অতিরিক্ত ব্যয় কম হয়। ইন্টারনেটের সুবিধায় এখন নিজেই অনলাইনে হোটেল, টিকেটসহ সবকিছু বুক করা যায়। যেমন আমাদের ভ্রমণ গাইড ওয়েবসাইটে দেশের সকল জনপ্রিয় পর্যটন স্থানের তথ্য পাওয়া যায়।
ট্রিপএডভাইসর, ট্রিভাগো, মাইট্রিপ, ইস্ক্যানারসহ আরও অনেক ওয়েবসাইটে বিভিন্ন সময় হোটেল ও যানবাহন সংস্থাগুলো ছাড় ও বিশেষ অফার দিয়ে থাকে। আগে থেকেই এসব ওয়েবসাইট থেকে বুকিং দিলে অনেক টাকা সাশ্রয় হয় এবং বাড়তি সুবিধাও পাওয়া যায়।
দেশে কিংবা বিদেশে প্লেনের টিকেট যত আগে বুক করবেন, দাম ততই কম পাবেন। বিপরীতে, যাত্রার কাছাকাছি সময়ে বুক করলে টিকেটের দাম প্রায় ৪০% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। তাই আগে থেকে পরিকল্পনা করে বুকিং করলে অনেক খরচ বাঁচানো সম্ভব।
৬. শুকনো খাবার ও পানি সাথে রাখুন
যেকোনো জায়গায়, বিশেষ করে দুর্গম স্থানে ভ্রমণের সময় অবশ্যই কিছু শুকনো খাবার যেমন মুড়ি, চিপস এবং পানীয় যেমন পানি, কোল্ড ড্রিংক বা ফলের রস সঙ্গে নিয়ে যান। এসব খাবার ও পানীয় বিপদের সময় কাজে লাগে এবং স্থানীয় দোকানের অতিরিক্ত দামের হাত থেকে আপনার পকেট রক্ষা করে।
ট্রেকিং বা পাহাড়ি এলাকায় দেখা যায় এক বোতল পানি ৩০ থেকে ৪০ টাকা এবং এক ক্যান কোক ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। তাই নিজের খাবার সঙ্গে নিয়ে গেলে খরচ অনেক কম হয়।
৭. এক্সপ্লোর করার অভ্যাস গড়ে তুলুন
কোনো স্থানে গেলে হুট করে দোকানে ঢুকে পছন্দসই জিনিস কেনার আগে এলাকাটি ভালো করে ঘুরে দেখুন। স্থানীয় বাজার, দোকান এবং রেস্তোরাঁগুলো যাচাই-বাছাই করুন। এতে আপনি ভালো দাম ও মানের জিনিস পেতে পারেন। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ নিন; তারা আপনাকে কম খরচে ভ্রমণ এবং জীবনযাত্রার সেরা জায়গাগুলো সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবেন।
৮. স্ট্রিট ফুড ও লোকাল খাবার উপভোগ করুন
ভ্রমণে গিয়ে স্ট্রিট ফুড বা স্থানীয় খাবারের দোকানগুলো ঘুরে দেখুন। কম খরচে সেরা স্বাদ পেতে পারবেন, পাশাপাশি সেই এলাকার জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির এক অনন্য ধারণাও পাবেন। সাধারণত জনপ্রিয় স্থানীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে খাওয়া ভালো এবং সাশ্রয়ী হয়। তাই ফাইন ডাইনিংয়ের পরিবর্তে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
৯. কমিউনিটি ট্যুরিজমের সেবা নিন
স্থানীয় লোকজন যারা পর্যটকদের জন্য বাড়ি, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে, তাকে কমিউনিটি ট্যুরিজম বলা হয়। বিদেশসহ কিছু দেশের পাশাপাশি আমাদের দেশে এখন এই সেবা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। কমিউনিটি ট্যুরিজমে হোটেলের তুলনায় সাধারণত খরচ অনেক কম, প্রায় অর্ধেক বা তারও কম। অনেক ক্ষেত্রে আপনি নিজে রান্না করতেও পারেন, যা খরচ কমানোর পাশাপাশি এক অনন্য অভিজ্ঞতাও দেয়।
১০. সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করুন
দেশের বেশির ভাগ জেলায় সরকারি গেস্টহাউস বা বাংলো রয়েছে, যা সময়ের ব্যবধানে ভাড়া দেওয়া হয়। এসব জায়গায় থাকতে চাইলে আগে থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়, এবং কখনো কখনো সরকারি রেফারেন্সও প্রয়োজন হতে পারে। তবে আগাম বুকিং দিলে থাকার খরচ অনেক কম পড়ে, যা ভ্রমণ বাজেটের জন্য বেশ উপকারী।
১১. দরদাম করুন ও অতিরিক্ত কেনাকাটা এড়িয়ে চলুন
ভ্রমণে গেলে দরদাম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। খাবার, হোটেল, যাতায়াত ও পর্যটন স্থানের খরচে দরদাম করলে আপনি অনেক সাশ্রয় করতে পারবেন।
অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করলে খরচ বেড়ে যায়। তাই কেনাকাটার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, “এটি কি সত্যিই প্রয়োজন?” স্থানীয় দোকানদাররা পর্যটকদের বেশি দাম দিতে পারে, তাই দরদাম করে বা আগে দাম সম্পর্কে ধারণা নিয়ে কেনাকাটা করুন।
এছাড়া ভ্রমণের জন্য বাজেট নির্ধারণ করুন এবং সেটি অতিক্রম না করার চেষ্টা করুন। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত খরচ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
১২. ব্যাকপ্যাক ট্রাভেলিং
পরিবারের সাথে না গিয়ে একা বা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গেলে চেষ্টা করুন ব্যাকপ্যাক ট্রাভেলিং করার। ব্যাকপ্যাকারদের জন্য বিদেশসহ অনেক জায়গায় আলাদা হোস্টেল থাকে, যেখানে হোটেলের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম খরচে থাকার ব্যবস্থা পাওয়া যায়। ব্যাকপ্যাক ট্রাভেল মানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সীমিত রেখে শুধুমাত্র একটি ব্যাকপ্যাক নিয়ে ভ্রমণ করা। এতে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার খরচ অনেক কম হয়।
১২. রাতে ভ্রমণ করুন
যদি ৬-১০ ঘণ্টার যাত্রা করতে হয়, তাহলে রাতের সময় বাস বা ট্রেনে ভ্রমণ করা ভালো। এতে রাতে ঘুমিয়ে সময় কাটানো যায় এবং পরবর্তী দিনের জন্য অতিরিক্ত সময় পাওয়া যায়। একইসঙ্গে এক রাতের হোটেল ভাড়া বাঁচানোও সম্ভব হয়।
১৩. ক্যাম্পিং করুন
যেখানে ভ্রমণ করবেন, যদি সেখানে ক্যাম্পিংয়ের সুযোগ থাকে, তাহলে এক বা দুই দিন ক্যাম্পিং করার কথা ভাবুন। এতে খরচ অনেক কমে যায় এবং ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতাও পাওয়া যায়। দেশের অনেক জনপ্রিয় পর্যটনস্থলে ক্যাম্পিং সুবিধা উপলব্ধ রয়েছে।
১৪. রুম সার্ভিস কম ব্যবহার করুন
হোটেলে থাকাকালীন রুম সার্ভিস যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। রুম সার্ভিসে অর্ডার করলে বিল ও বকশিশ মিলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। নিজে বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়া কিংবা হোটেলের ডাইনিং ব্যবহার করলে অনেক খরচ সাশ্রয় হয়।
১৫. লন্ড্রি সার্ভিস এড়িয়ে চলুন
হোটেলের লন্ড্রি সার্ভিসও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চার্জ নেয়। তাই সঙ্গে ছোট মাপের লন্ড্রি পাউডার রাখুন এবং নিজে নিজে কাপড় ধোয়ার চেষ্টা করুন। এতে খরচ অনেক কম হয়।
উপসংহার
ভ্রমণ মানুষের মনের খোরাক, কিন্তু পকেটের সঙ্গতি না থাকলে সেই আনন্দ হারিয়ে যায়। তবে কিছু সহজ ও কার্যকরী কৌশল মেনে চললেই কম খরচে স্মরণীয় ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব।
দলীয়ভাবে ভ্রমণ, অফ-পিক সিজনে যাওয়া, নিজেরাই সব আয়োজন করা, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার, প্রি-বুকিং, শুকনো খাবার সঙ্গে রাখা, স্থানীয় কমিউনিটি ট্যুরিজমে অংশগ্রহণ—এসব উপায় খরচ অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি ব্যাকপ্যাক ট্রাভেলিং, রাতে ভ্রমণ, ক্যাম্পিং করা, রুম সার্ভিস ও লন্ড্রি সার্ভিস কম ব্যবহার, দরদাম করা ও অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা এড়িয়ে চলাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এসব উপায় মেনে চললে আপনি ভ্রমণের আনন্দ পেতে পারবেন বিনা অতিরিক্ত ব্যয়ে, এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাবেন। তাই পরিকল্পিত, সচেতন ও বুদ্ধিমানের সঙ্গে চলুন ভ্রমণের পথে, আর সাশ্রয়ী ভ্রমণকে করে তুলুন আপনার নিত্যসঙ্গী।
মন্তব্য