
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গন্তব্য। "নারিকেল জিঞ্জিরা" নামে পরিচিত এই দ্বীপ কক্সবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানকার নীল আকাশ ও সমুদ্রের জলরাশির মিতালী, সারিবদ্ধ নারিকেল গাছ এবং প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
সেন্টমার্টিন ভ্রমণ পরিকল্পনা
এই গাইডে আপনি সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ট্যুর প্ল্যান, যাতায়াত ব্যবস্থা, থাকা-খাওয়ার সুবিধা এবং খরচ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। আরও তথ্যের জন্য নিচের লিংকগুলো থেকে আমাদের ভ্রমণ গাইড পড়ে নিন।
যাতায়াত ও টিকেট বুকিং
বর্তমানে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ আগের তুলনায় কিছুটা জটিল। পূর্বে টেকনাফ থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল করলেও এখন শুধুমাত্র কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনের জাহাজ পাওয়া যায়। এ কারণে যাতায়াতের সময় বেশি লাগে। তাই দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার পরিকল্পনা না করাই ভালো, কারণ জাহাজে করে সেন্টমার্টিন পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পরই আবার কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ফিরে যেতে হয়।
এছাড়া, প্রতিদিন পর্যটক সংখ্যা সীমিত থাকায় টিকেট পাওয়া কঠিন। তাই আগে থেকে জাহাজের টিকেট এবং প্রয়োজনে রিসোর্ট বুকিং করে নিন। সেন্টমার্টিন জাহাজের ভাড়া, টিকেট বুকিং ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য আমাদের ভ্রমণ গাইড পড়ুন।
সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত পরিবেশ ভ্রমণকারীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা বয়ে আনে। ভালোভাবে পরিকল্পনা করে গেলে এই দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করা আরও সহজ হবে।
সেন্টমার্টিন ট্যুর প্ল্যান ১: দুই দিন এক রাত
সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতে হলে প্রথমে আপনাকে কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে। যেখান থেকেই আসুন না কেন, এমনভাবে পরিকল্পনা করুন যাতে সকালে জাহাজ ছাড়ার আগেই কক্সবাজারে পৌঁছাতে পারেন। ঢাকা থেকে রাত ৮-৯টার মধ্যে বাসে রওনা দিলে পরদিন সকাল ৬-৭টার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছানো সম্ভব। ঢাকা থেকে কক্সবাজারে বাসে সাধারণত ৯-১১ ঘণ্টা সময় লাগে। শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন, মডার্ন লাইন, গ্রীন লাইনসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস এ রুটে চলাচল করে। বাসের শ্রেণিভেদে টিকেটের মূল্য ৯০০ থেকে ২৭০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। প্রয়োজনে ভ্রমণের আগের দিনই কক্সবাজার চলে আসতে পারেন।
প্রথম দিন
কক্সবাজারে পৌঁছে সরাসরি চলে যান নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটি ঘাটে। এখান থেকেই সেন্টমার্টিনের জাহাজগুলো ছেড়ে যায়। জাহাজের সময়সূচি জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়, তাই টিকেট কাটার সময় সময় জেনে নিন। কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজে প্রায় ৪-৬ ঘণ্টা সময় লাগে। সবকিছু ঠিক থাকলে দুপুর ২টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে দ্বীপে পৌঁছে যাবেন।
সেন্টমার্টিনে পৌঁছে প্রথমে হোটেল বুকিং করুন (যদি আগে থেকে বুকিং না করে থাকেন)। এরপর হাতে সময় থাকলে সমুদ্রস্নান করতে পারেন অথবা বিকেলে পশ্চিম বীচে সূর্যাস্ত উপভোগ করুন। রাতের খাবারের জন্য হোটেলেই অর্ডার দিতে পারেন অথবা আশেপাশের রেস্তোরাঁগুলোতে খেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কেয়ারি মারজান রেস্তোরাঁ, বিচ পয়েন্ট, হোটেল আল্লার দান, বাজার বিচ, আসাম হোটেল, সি বিচ, কুমিল্লা রেস্টুরেন্ট, রিয়েল রেস্তোরাঁ, হাজী সেলিম পার্ক বা হোটেল সাদেক বেছে নিতে পারেন।
রাতে বারবিকিউ করতে চাইলে হোটেল ম্যানেজারের সাথে আগেই কথা বলুন। অথবা সেন্টমার্টিন বাজারে গিয়ে টাটকা মাছ কিনে বারবিকিউ করতে পারেন—এক্ষেত্রে দামাদামি করে নেওয়া ভালো।
দ্বিতীয় দিন
ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাইকেল বা মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে অথবা হেঁটে পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখুন। সঙ্গে পর্যাপ্ত পানি নিতে ভুলবেন না। চাইলে ছেঁড়া দ্বীপে সময় কাটাতে পারেন। দুপুরের আগে শেষ সমুদ্রস্নান সেরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে জাহাজের সময় অনুযায়ী ঘাটে চলে আসুন।
কক্সবাজারে ফিরে কলাতলী থেকে ঢাকার বাসে বা ট্রেনে রওনা দিন। মনে রাখবেন, জাহাজের সময়সূচি পরিবর্তন হতে পারে, তাই টিকেট এমন সময়ে নিন যাতে বাস বা ট্রেন মিস না হয়।
সেন্টমার্টিন ট্যুর প্ল্যান ২ : তিন দিন দুই রাত
বর্তমানে জাহাজের সময়সূচি ও সেন্টমার্টিন যাওয়ার নিষেধাজ্ঞার কথা বিবেচনা করে, এক রাতের পরিবর্তে দুই রাত থাকার পরিকল্পনা করলে ভ্রমণটি আরও উপভোগ্য হবে। এতে দ্বীপটি ভালোভাবে ঘুরে দেখার সুযোগ মিলবে। এক রাতের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার চেয়ে কিছুটা বেশি খরচ হলেও দুই রাত থাকলে অভিজ্ঞতা হবে স্মরণীয়।
প্রথম দিন
প্রথম দিনের রুটিন আগের পরিকল্পনার মতোই কাটিয়ে নিন।
দ্বিতীয় দিন
দ্বিতীয় দিনের সকাল বা বিকেল ছেঁড়া দ্বীপ ভ্রমণের জন্য রাখুন। তবে বিকেলে ছেঁড়া দ্বীপে গেলে সবচেয়ে ভালো লাগবে। সকালে হেঁটে বা সাইকেলে চড়ে পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে পারেন—এতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগবে।
দুপুরে সাগরে গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিন। এরপর জাহাজ ঘাট থেকে ট্রলার বা বোটে ছেঁড়া দ্বীপে যান। সেখানে বিকেল কাটিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ফিরে আসুন।
কেনাকাটার ইচ্ছা থাকলে সন্ধ্যায় সেন্টমার্টিন বাজারে সময় কাটিয়ে রিসোর্টে ফিরে যান। রাতে ক্যাম্পিং বা বারবিকিউ করার ব্যবস্থা করতে পারেন। সাগরপাড়ের এই রাতের আড্ডা আপনার স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে।
তৃতীয় দিন
সকালে নাস্তা সেরে শেষবারের মতো সাগরে স্নান করে ফেরার প্রস্তুতি নিন। জাহাজের সময় অনুযায়ী ঘাটে পৌঁছে কক্সবাজারে ফিরে আগের পরিকল্পনা মতোই সময় কাটান।
পরামর্শ:
জাহাজের সময়, দীর্ঘ যাত্রাপথ ও হোটেল বুকিংয়ের জটিলতা বিবেচনায় সেন্টমার্টিন ভ্রমণ এখন কিছুটা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। ছোট শিশু থাকলে সরাসরি সেন্টমার্টিন না গিয়ে কক্সবাজারে এক দিন কাটিয়ে যাত্রা করলে ভ্রমণ আরামদায়ক হবে।
সেন্টমার্টিন ভ্রমণ খরচ
যেকোনো ভ্রমণের খরচ সম্পূর্ণভাবে আপনার পছন্দ ও পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল। আপনি কীভাবে ভ্রমণ করবেন, কোথায় থাকবেন, কী খাবেন এবং কোন মৌসুমে যাচ্ছেন—এসব বিষয়ই আপনার মোট খরচ নির্ধারণ করবে। সাধারণত ছুটির দিনগুলোতে থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য খরচ কিছুটা বেশি হয়। ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে মোটামুটি মানের হোটেলে থাকা ও খাওয়ার খরচ সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার জন্য নিচে একটি আনুমানিক খরচ তালিকা দেওয়া হলো:
যাতায়াত খরচ:
বাস ভাড়া (ঢাকা থেকে টেকনাফ):
- নন-এসি: ১,৮০০ টাকা (আসা-যাওয়া)
- এসি: ৩,১০০–৩,৪০০ টাকা (আসা-যাওয়া)
শিপ/জাহাজ ভাড়া (টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন): ২,২০০–৩,০০০ টাকা (আসা-যাওয়া)
- ছেড়া দ্বীপ ভ্রমণ (ট্রলার ভাড়া): ২০০–৩০০ টাকা
- স্থানীয় যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ: ৫০০–১,০০০ টাকা
খাবারের খরচ:
- সকালের নাস্তা: ১০০–১৫০ টাকা
- দুপুর ও রাতের খাবার: প্রতি বেলা ২০০–৪০০ টাকা
- বারবিকিউ: জনপ্রতি ৪০০–৬০০ টাকা
(বাজারের ভিতরের সাধারণ হোটেলে খেলে খরচ আরও কম হবে)
থাকার খরচ:
- স্ট্যান্ডার্ড হোটেল/রিসোর্ট (ডাবল বেড): ২,০০০–৪,০০০ টাকা/রাত
- পিক সিজন বা ছুটির দিনে: ভাড়া কিছুটা বেশি হতে পারে
- সি-ভিউ বা প্রিমিয়াম রিসোর্ট: ৪,০০০–১২,০০০ টাকা/রাত
খরচ কমানোর উপায়:
- এক রুমে ৪ জন থাকলে খরচ ভাগ হয়ে কমে যাবে।
- ছুটির দিন ছাড়া গেলে ডিসকাউন্ট পাওয়া যেতে পারে।
- বাজারের কাছাকাছি স্থানীয় হোটেলে থাকলে খরচ আরও সাশ্রয়ী হবে।
এই হিসাব থেকে আপনি সেন্টমার্টিন ভ্রমণের আনুমানিক খরচ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। তবে প্রকৃত খরচ আপনার ভ্রমণের সময় ও পছন্দের উপর ভিত্তি করে কিছুটা কম-বেশি হতে পারে।
মন্তব্য