একদিনে টাঙ্গাইলের পাঁচ জমিদার বাড়ি ভ্রমণ

একদিনে টাঙ্গাইলের পাঁচ জমিদার বাড়ি ভ্রমণ

ঢাকার একদম কাছেই টাঙ্গাইল জেলায় ছড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি পুরনো জমিদার বাড়ি, যেগুলোর প্রতিটিই যেন ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। চাইলে সকালে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে একদিনেই এসব ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলো ঘুরে দেখা যায়। আমাদের অতিথি লেখক জসিম উদ্দিন সম্প্রতি এই ভ্রমণটা সেরে এসেছেন এবং তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এই ভ্রমণ গাইডে।

অনেক দিন ধরেই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ভাবনা মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু কোথায় যাব? আর ব্যাংকের চাকরির কারণে ছুটি পাওয়া তো একেবারেই দুষ্কর! হঠাৎ করে একটা ট্রেনিংয়ের সুযোগ এল আর আমি ঠিক করে ফেললাম — টাঙ্গাইলের সব জমিদারবাড়ি ঘুরেই আসব।

আগেই বলে রাখি, আমি খুব গুছিয়ে লেখার মানুষ না। তাই কোথাও যদি লেখায় খামতি থাকে, তা দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এই ভ্রমণে আমি যেসব জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখেছি, সেগুলোর তালিকাই এখন শেয়ার করছি আপনাদের সঙ্গে।

১. করটিয়া জমিদার বাড়ি

টাঙ্গাইল পৌঁছানোর কিছু আগেই নেমেছিলাম করটিয়ায়। প্রধান সড়ক থেকে একটা অটোরিকশা ভাড়া করে রওনা হলাম ঐতিহাসিক করটিয়া জমিদারবাড়ির দিকে। বাড়ির মূল ফটকে পৌঁছাতেই এক দিদিমার মতো একজন কেয়ারটেকার হেসে বললেন, “ভেতরে ঢুকতে চাইলে কিছু খরচাপাতি লাগবে কিন্তু।” আমরা হেসে ৫০ টাকা এগিয়ে দিলাম।

ভেতরে ঢুকেই যেন এক অন্য সময়ে চলে গেলাম। পুরনো সেই রাজকীয় ভবনের দেয়ালজুড়ে শোভা পাচ্ছে হরিণের শিং আর শিকার করা জন্তুদের মাথার খুলি – তখনকার জমিদারদের শৌখিনতার নিদর্শন। দেয়ালে টাঙানো ছবি, আসবাবপত্র – সবই যেন একেকটা গল্প বলছে। কাঠের তৈরি আসবাবগুলো এখনও বেশ মজবুত, যদিও সময়ের ছাপ পড়েছে কিছুটা।

শুনলাম, এই বাড়িটিই অভিনেতা নাঈমের নানার বাড়ি। বর্তমানে তারা ঢাকার বারিধারায় থাকেন, মাঝে মাঝে আসেন এখানে। তাই দ্বিতীয় তলায় এখনও একটা এয়ারকন্ডিশনার দেখা যায় – আধুনিকতার হালকা ছোঁয়া। তবুও, এই বাড়িতে বসে থাকলেই একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে মন জুড়ে।

জমিদারবাড়ির দু'টি বড় ভবন – সামনের দালানটি দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মাঝখানে রয়েছে বিশাল এক পুকুর। বর্ষাকালের কারণে পুকুরে হাঁটুপানি জমে আছে আর হলুদ রঙের ব্যাঙেরা এখানে-সেখানে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে – দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে!

দ্বিতীয় ভবনটি এখন একটি স্কুল ও কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশে শিক্ষার এমন আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়।

আরও এক জমিদারবাড়ি আছে করটিয়া বাজারের পাশে। যদিও সেটিতে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ নাও মিলতে পারে, তবে বাইরে থেকেই এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। পাশেই আছে এক শান্ত সুন্দর মসজিদ – যেন পুরো এলাকাটিকেই ঘিরে রেখেছে এক আভিজাত্য ও ইতিহাসের ছায়া।

২. পাকুল্লা জমিদার বাড়ি

মহেড়া থেকে বাসে চেপে খুব একটা দূর যেতে হয়নি—পাকুল্লায় নেমে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম এক ঐতিহাসিক ঠিকানায়। চোখের সামনে ভেসে উঠল লাল রঙের বিশাল সাইডওয়াল ঘেরা, কার্পেট বিছানো খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি দুই তলা জমিদার বাড়ি। বাড়িটির সৌন্দর্য এবং রুচিশীল স্থাপত্য মুগ্ধ না করে পারে না।

কিছুটা এগোতেই নজরে এলো বাড়ির প্রধান ফটকের পাশেই একটি কক্ষ, যেখানে কয়েকজন মানুষ বসে আছেন। ভাবলাম, আগে ছবিগুলো তুলে নিই। ফটোসেশন শেষে সাহস করে গিয়েই পরিচিত হলাম তাদের সঙ্গে।

জানতে পারলাম, বাড়িটির বর্তমান উত্তরাধিকারী—এই জমিদার পরিবারের সপ্তম প্রজন্ম—সামনের অফিসঘরে বসে আছেন। ভিতরে রয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা, যদিও বাকি সবাই এখন ঢাকায় থাকেন। ছবি তোলার অনুরোধ করলেও, সেদিন আর সেটা সম্ভব হয়নি—জমিদারীয় ভাবভঙ্গিতে খালি গায়ে বসে থাকা তাঁর গাম্ভীর্য দেখে আর কিছু বলার সাহস করিনি।

আলাপচারিতায় জানতে পারি, কাছেই—বাজার সংলগ্ন এলাকায়—আছে দেলদুয়ার জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষী শাহী জামে মসজিদ। যদিও দেখতে পেরেছিলাম, মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারিনি।

৩. দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি

শেয়ারে সিএনজি করে রওনা দিলাম দেলদুয়ার জমিদার বাড়ির পথে। সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি, চারপাশে ঠান্ডা একটা আবহ — ঘোরাঘুরির জন্য একেবারে পারফেক্ট পরিবেশ। দেলদুয়ার পৌঁছে একটা রিকশা নিলাম। (এই রিকশাটাই যেন আজকের সফরের টার্নিং পয়েন্ট!)

রিকশা চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ল বিশাল এক পুরনো বাড়ির রাস্তা। দেখেই বোঝা যায়—এই বাড়ির জমিদার বেশ প্রতাপশালী ছিলেন। পাশেই পুরনো এক শতবর্ষী মসজিদ, আর সামনে একখানা বড় পুকুর, পুরো এলাকাটাই যেন সময় থেমে আছে।

জমিদার বাড়ির ভেতরে ঢোকার জন্য দুটি গেটের কাছেই গিয়ে চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভাগ্য ভালো, আমাদের রিকশাওয়ালার চেনাজানার সূত্রে কেয়ারটেকারকে রাজি করিয়ে শেষমেশ ঢুকতে পারলাম।

ভেতরে ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সবুজ খড় বিছানো বিশাল উঠান, পাশে শতবর্ষী বিশাল গাছগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে—যেন চুপচাপ সাক্ষী হয়ে আছে এই বাড়ির ইতিহাসের উত্থান-পতনের।

আরেকটু এগোতেই দেখতে পেলাম জমিদার পরিবারের পারিবারিক কবরস্থান। এক ডজনেরও বেশি কবর, মার্বেল পাথরে খোদাই করা জন্ম-মৃত্যু বছরের নামফলক — পুরো জায়গাটা এক অদ্ভুত শান্তির পরশে ঘেরা। পাশে কাঠবাদামের গাছ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে মিষ্টি সুবাস।

বাড়ির নাম “নর্থ হাউস”। লাল-সাদা রঙে নতুন করে চুনকাম করা হয়েছে, কিন্তু পুরনো ইটগুলোর স্পর্শ এখনো ধরে রেখেছে ইতিহাসের ছোঁয়া। দেখতে হুবহু মনে হলো যেন ব্রিটিশ আমলের কোনো মন্ত্রীর বাড়ি! পরে জানতে পারলাম, সত্যিই এই বাড়ির জমিদার ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একজন মন্ত্রী।

আরও অনেক কিছু জানার ইচ্ছে থাকলেও, আমাদের যাত্রা ছিল আরেকটি জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাই বিদায় নিলাম “নর্থ হাউস” থেকে — স্মৃতির ঝুলিতে একটি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নিয়ে।

৪. মহেড়া জমিদার বাড়ি

এরপর আমরা রওনা দিলাম মহেড়া জমিদার বাড়ির দিকে। করটিয়া প্রধান সড়ক থেকে বাসে করে নামলাম মহেড়া মোড়ে। সেখান থেকে দু’জন মিলে সিএনজি রিজার্ভ করে পৌঁছে গেলাম মহেড়া জমিদার বাড়িতে।

এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি এখন বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। সরকার এটি অধিগ্রহণ করে এখানে গড়ে তুলেছে একটি পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, তবে এটি দর্শনার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত – নির্ধারিত টিকিট কেটে প্রবেশ করা যায়।

মহেড়া জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বিশাল এক পুকুর এবং তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জমিদার আমলের দালান-কোঠা। এখানে রয়েছে তিনটি বড় এবং দুটি ছোট পুরোনো ভবন, প্রতিটি ভবনের সামনেই রয়েছে মনোরম বাগান। ভবনগুলোর পেছনে রয়েছে পুলিশের ট্রেনিং সংক্রান্ত নতুন একটি ভবন, যেটি সম্ভবত ডরমেটরি হিসেবে ব্যবহৃত হয় (যদিও আমি নিশ্চিত না)। পাশেই একটি মসজিদ আছে, যেখানে আমরা জোহরের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে বেরিয়ে পরবেন আরেকটি জমিদার বাড়ির খোঁজে — নতুন এক ইতিহাসের ছোঁয়া পেতে।

৫. নাগরপুর জমিদার বাড়ি

পোড়াবাড়ী থেকে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে আমরা ৩০০ টাকায় পৌঁছে গেলাম নাগরপুর। যদি আপনি সাশ্রয়ী ভ্রমণ করতে চান, তবে শেয়ারে গিয়েও যেতে পারেন—তাতে খরচ হবে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা।

নাগরপুর পৌঁছে একটি রিকশা নিয়ে সরাসরি চলে গেলাম জমিদারবাড়ির সামনে। কিন্তু গিয়ে দেখি, সমস্ত গেট বন্ধ! আশেপাশে কারও কাছ থেকে সঠিকভাবে জানতে পারলাম না, জমিদারবাড়ির আসল সীমানা কোথা থেকে কোথায়। সামনে দুটি পুরোনো ও বিশাল দালান নজরে পড়ল—সেখানে এখন ‘নাগরপুর মহিলা অনার্স কলেজ’ চালু হয়েছে।

বাড়ির সামনের পুকুরঘাটে বসে কিছু সময় কাটালাম। ২-৩টা ছবি তুলে রাখলাম, ভাবলাম—যদি ভেতরে ঢুকতে না পারি, এই ছবি দিয়েই স্মৃতি রক্ষা করব। এরপর চারপাশে ঘুরে ৫-৬টা পুরনো বাড়ি দেখতে পেলাম, কিন্তু কোথাও ঢোকার সুযোগ বা কোনো পথ খুঁজে পেলাম না।

শেষমেশ, মূল ফটকে এসে মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে বাইরে থেকে প্রধান দালানগুলোর ছবি তুলে রাখলাম। পরে শুনলাম, ভেতরে এখন কেউ থাকে না এবং গোপনে সিসিটিভি বসানো হয়েছে। যেহেতু সেদিন ছিল শনিবার, কলেজ বন্ধ ছিল—তাই কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদি খোলার দিনে যেতাম, হয়তো ভিতরে ঢোকার সুযোগ মিলত—তবে সেটাও নিশ্চিত বলা যায় না।

শেষ পর্যন্ত যা দেখতে পেরেছি, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে রওনা দিলাম টাঙ্গাইল শহরের দিকে—গন্তব্য ঐতিহাসিক ‘টাঙ্গাইলের চমচম’ চেখে দেখা। এরপর সোজা ফেরত ঢাকায়।

 

মন্তব্য