পেলিং কিভাবে যাবেন থাকা খাওয়ার সকল তথ্য

পেলিং কিভাবে যাবেন থাকা খাওয়ার সকল তথ্য

পেলিং পশ্চিম সিকিমের একটি জনপ্রিয় হিল স্টেশন, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় দৃশ্য উপভোগ করার জন্য এই স্থানটি বিশেষভাবে বিখ্যাত। পেলিংকে মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে—আপার পেলিং, মিডল পেলিং এবং লোয়ার পেলিং। চারপাশের অপরূপ প্রকৃতি, মনোরম ঝর্ণা, নদী, কমলালেবুর বাগান, পাহাড়বেষ্টিত লেক, সবুজ উপত্যকা, প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ এবং আকর্ষণীয় ব্রিজ পেলিংয়ের ভ্রমণকে করে তোলে আরও বেশি মোহনীয়। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য পেলিং একটি স্বর্গীয় গন্তব্য।

পেলিংয়ের দর্শনীয় স্থানসমূহ

পেলিংয়ের নিচে অবস্থিত দারাপ গ্রাম (Darap Village) হোম স্টে করার জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পেলিং থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার।

রিম্বি ফলস (Rimbi Falls)

পেলিংয়ের কাছাকাছি একটি আকর্ষণীয় স্থান হলো রিম্বি জলপ্রপাত। দারাপ গ্রাম থেকে আরও ৬ কিলোমিটার গেলেই রাস্তার বাঁ পাশে দেখা মিলবে এই সুন্দর ঝর্ণাটির। মাঝারি উচ্চতার এই জলপ্রপাতটি দেখতে রেশমের মতো নরম ও মোহনীয়। বর্ষার পর এখানে জলের প্রবাহ বেশ ভালো থাকে। জলপ্রপাতের নিচে একটি ছোট কুণ্ডের মতো অংশ তৈরি হয়েছে।

রিম্বি ঝর্ণা থেকেই রিম্বি খোলা নদীর উৎপত্তি। এই নদীর উপর নির্মিত হয়েছে রিম্বি হাইড্রো প্রজেক্ট। রিম্বি নদী পাশে রেখে কিছুদূর এগোতেই দেখা মিলবে রিম্বি অরেঞ্জ গার্ডেন (Rimbi Orange Garden)—এটি এই অঞ্চলের একটি নতুন পর্যটন স্পট। এখানে টিকিট কেটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নদীর তীরে পৌঁছানো যায়। সুন্দরভাবে সাজানো বাগানে রয়েছে নানা রঙের ফুল ও কমলালেবুর গাছ। আরও নিচে নেমে গেলে দেখা মিলবে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী রিম্বি খোলা, যা পাথরের ফাঁক দিয়ে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে।

কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস (Kanchenjunga Falls)

পেলিং থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত সিকিমের সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণাগুলোর মধ্যে একটি। ঘন সবুজ পাহাড়ের পটভূমিতে দুধসাদা ফেনিল জলরাশি উচ্চ থেকে সশব্দে নিচে পড়ছে, যা দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে। এই জলপ্রপাতটি দুটি অংশে বিভক্ত—উপর থেকে পাথর বেয়ে ধাপে ধাপে জল নিচে পড়ার পর আবারও একটি প্রধান ধারা হিসেবে গর্জে নিচে আছড়ে পড়ছে।

ঝর্ণার খুব কাছাকাছি যাওয়া কঠিন, কারণ জলের ছিটে লাগলে ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে মূল জলপ্রপাতের পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। কথিত আছে, এই জলধারা কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমবাহ থেকে উৎপন্ন। এখানে কিছু দোকান ও রেস্তোরাঁ রয়েছে, যেখানে খাওয়া-দাওয়া করা যায়। এছাড়া, ইদানীং এখানে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

খেচিপেরি লেক (Khecheopalri Lake)

খেচিপেরি লেক পেলিংয়ের আরেকটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। লেকের গেট থেকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ১০ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। পাহাড়ে ঘেরা এই বিশাল লেক স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। একে ইচ্ছাপূরণের লেক (Wishing Lake)ও বলা হয়। লেকের পাড়ে রঙবেরঙের পতাকা দেখা যায়। কথিত আছে, এই লেকের জলে কোনো পাতা পড়ে না, যদিও চারপাশে অসংখ্য গাছ রয়েছে।

খেচিপেরি লেকের কাছে একটি বড় বৌদ্ধ মঠ ও কনভেনশন সেন্টার গড়ে উঠেছে।

সিংশোর ব্রিজ (Singshore Bridge)

পেলিং থেকে সিংশোর ব্রিজ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাস্পেনশন ব্রিজ। এই ঝুলন্ত সেতু দিয়ে হেঁটে পার হওয়ার সময় নিচে গভীর খাদে একটি পাহাড়ি নদী প্রবাহিত হতে দেখা যায়। ব্রিজ থেকে নিচে তাকালে মাথা ঘুরে যেতে পারে—এতটাই গভীর এই খাদ যে, উপর থেকে পাথর ফেললে নিচে পৌঁছতে ৮ সেকেন্ড সময় লাগে!

সিংশোর ব্রিজ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ডেন্টাম ভ্যালি অবস্থিত, যেখানে রয়েছে বিখ্যাত অ্যাল্পাইন চিজ ফ্যাক্টরি।

উত্তরে গ্রাম (Uttarey Village)

সিংশোর ব্রিজ থেকে আরও ৫ কিলোমিটার উত্তরে উত্তরে গ্রাম অবস্থিত, যা ভারত-নেপাল সীমান্তের শেষ গ্রাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রামটি পাইন গাছে ঘেরা এক মনোরম উপত্যকায় অবস্থিত। এখান থেকে বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুট শুরু হয়। পর্যটকদের থাকার জন্য উত্তরে কয়েকটি হোটেল রয়েছে।

পেমায়াংৎসে মঠ (Pemayangtse Monastery)

পেলিং থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত পেমায়াংৎসে মঠ সিকিমের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বৌদ্ধ মঠ। ১৭০৫ সালে নির্মিত এই মঠে তিব্বতি শৈলীতে তৈরি নানা মূর্তি, চিত্রকলা ও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। মঠের তিনতলায় একটি আশ্চর্য কাঠের কাঠামো রয়েছে, যা গুরু রিনপোচের স্বর্গীয় প্রাসাদের প্রতীক (Sanghthokpalri)।

মূল উপাসনালয়ে সকালে লামাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও তিব্বতি বাদ্যযন্ত্রের মধুর সুর শোনা যায়। ধর্মীয় গুরুত্বের দিক থেকে পেমায়াংৎসে মঠ সিকিমের অন্যতম প্রধান মঠ।

যাত্রাপথের সতর্কতা

বর্ষাকালে পেলিং থেকে ডেন্টামের রাস্তা ধসের কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই ভ্রমণের আগে রাস্তার অবস্থা জেনে নেওয়া ভালো।

পেলিং ও তার আশেপাশের এই দর্শনীয় স্থানগুলো প্রকৃতি প্রেমী ও অ্যাডভেঞ্চার seekersদের জন্য এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে!

একনজরে পেলিং এর দর্শনীয় স্থানগুলো

সঙ্গাচোলিং চেনরেজিগ ট্যুরিজম পার্ক ও স্কাইওয়াক
একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট যেখানে প্রকৃতির মাঝে স্কাইওয়াকের অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়।

সঙ্গাচোলিং মঠ (সিকিমের প্রাচীনতম মঠ)
সিকিমের সবচেয়ে পুরনো বৌদ্ধ মঠ, যা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে।

ছাঙ্গে জলপ্রপাত
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা একটি মনোরম জলপ্রপাত, পিকনিক ও প্রকৃতি উপভোগের জন্য আদর্শ।

রিম্বিক জলপ্রপাত
অরণ্যের গভীরে অবস্থিত এই জলপ্রপাত শান্তি ও প্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার জন্য উপযুক্ত।

রক গার্ডেন
শিলা ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি সুন্দর বাগান, হাঁটাহাঁটি ও ছবি তোলার জন্য জনপ্রিয়।

কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত
বরফে ঢাকা পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত এই জলপ্রপাতের দৃশ্য অত্যন্ত মোহনীয়।

খেচোপালরি পবিত্র হ্রদ ও মঠ
সিকিমের পবিত্রতম হ্রদগুলির মধ্যে একটি, যা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

কিভাবে যাবেন

এনজিপি বা শিলিগুড়ি থেকে রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে তিস্তা বাজার, মেলি, জোরথাং, লেগশিপ ও গেজিং হয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় পেলিং পৌঁছানো যায়। সিজন সময়ে রিজার্ভ গাড়ির ভাড়া পড়বে প্রায় ২০০০ রুপি।

অন্যদিকে, গ্যাংটক থেকেও সরাসরি পেলিং যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে পেলিং ঘুরে তারপর গ্যাংটক যাওয়াই ভালো, এতে সময় সাশ্রয় হয়। ফেরার সময় গ্যাংটক থেকেই ফিরে আসতে পারবেন।

খেয়াল রাখবেন, এনজেপি থেকে পেলিং যাওয়ার জীপস্ট্যান্ড আলাদা অবস্থানে রয়েছে।

কোথায় থাকবেন

আপার পেলিং-এ হোটেলের ভাড়া কিছুটা বেশি। মিডল ও লোয়ার পেলিং-এ তুলনামূলকভাবে কম। সাধারণত ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকার মধ্যে ভালো হোটেল পাওয়া যায়। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য দেখা যায় এমন রুমের ভাড়া স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়।

Comments (0)
এখনো কোনো মন্তব্য নেই

প্রথম মন্তব্য করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!

আপনার মন্তব্য লিখুন