
ভ্রমণ হলো জীবনের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের চূড়া, সবুজ অরণ্য, নির্জন সমুদ্রসৈকত কিংবা অজানা কোনো গ্রামের পথে হেঁটে আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। কিন্তু প্রকৃতির এই রূপের আড়ালে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে ভয়ানক বিপদ। বজ্রপাত (Thunderstorm) তেমনই এক আকস্মিক দুর্ঘটনা, যা মুহূর্তেই একটি আনন্দময় যাত্রাকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বজ্রপাতে বহু মানুষ প্রাণ হারায় বা গুরুতর আহত হয়। বিশেষ করে পাহাড়, খোলা মাঠ বা জলাশয়ের কাছে ভ্রমণকারীদের বজ্রপাতের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
বজ্রপাত কিভাবে ঘটে
বজ্রপাত মূলত বৈদ্যুতিক আধানের দ্রুত পরিবাহিত হওয়ার ফল। মেঘের ভেতরে বা মেঘ ও ভূ-পৃষ্ঠের মধ্যে যখন বৈদ্যুতিক বিভবের পার্থক্য তৈরি হয়, তখনই আকাশে বিদ্যুতের চমক ও প্রচণ্ড শব্দ সৃষ্টি হয়। এই আলোকচ্ছটা এবং গর্জন একদিকে যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি এটি অত্যন্ত বিপজ্জনকও বটে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর হাজারো মানুষ বজ্রাঘাতে প্রাণ হারায় বা আহত হয়। বাংলাদেশের মত মৌসুমি বৃষ্টিপাতবহুল অঞ্চলে এই ঝুঁকি আরও বেশি। তাই যাত্রা শুরু করার আগে বজ্রপাত সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভ্রমণের সময় বজ্রপাতের ঝুঁকি কেন বেশি
ভ্রমণের সময় আমরা প্রায়ই খোলা মাঠ, উঁচু পাহাড়, সমুদ্রের কিনারা বা জলাশয়ের পাশে সময় কাটাই। এসব স্থান বজ্রপাতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। উঁচু জায়গায় অবস্থানের কারণে আমাদের শরীর বজ্রপাতের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে। এছাড়া, ভ্রমণের সময় আমরা বিভিন্ন ধাতব জিনিস ব্যবহার করি—যেমন ক্যামেরা, ট্রাইপড বা হাঁটার লাঠি—যেগুলো বজ্রপাতের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। তাই সামান্য অসাবধানতা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বজ্রপাতের সময় কি করবেন
১. আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানুন
যাত্রার আগে ও পথে নিয়মিত আবহাওয়ার খবর দেখুন। বজ্রপাতের আশঙ্কা থাকলে যাত্রা পিছিয়ে দিন বা বিকল্প পথ বেছে নিন। বর্তমানে স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই আবহাওয়ার হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায় - সেগুলো ব্যবহার করুন।
২. নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করুন
বজ্রপাত দেখা দিলে দ্রুত কংক্রিটের দৃঢ় ভবন বা গাড়ির ভেতর প্রবেশ করুন। গাড়িতে থাকলে সব জানালা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখুন। সতর্ক থাকুন - টিনের ছাদ, ক্ষুদ্র কুঁড়েঘর বা পাতলা কাঠের কাঠামো কোনোভাবেই নিরাপদ নয়।
৩. উচ্চস্থান পরিহার করুন
পর্বতশৃঙ্গ, মালভূমি, বৃক্ষশাখা - এসব স্থান বজ্রপাতের সময় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মুক্ত প্রান্তরে অবস্থান করলে দ্রুত নিম্নাঞ্চলে সরে যান।
৪. নিচু হয়ে থাকুন
মাঠেঘাটে বজ্রপাত হলে দাঁড়ানো অত্যন্ত বিপজ্জনক। দুই পা গুটিয়ে বসে পড়ুন, শরীর যতটা সম্ভব নত করুন এবং মাথা সুরক্ষিত রাখুন। কখনই সম্পূর্ণভাবে মাটিতে শয়ন করবেন না।
৫. ধাতব ও বৈদ্যুতিক বস্তু থেকে দূরে থাকুন
সেলফোন, ডিজিটাল ডিভাইস, ছাতা, ট্রেকিং পোল - বজ্রপাতের সময় এগুলো সংরক্ষণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো দূরে সরিয়ে রাখুন এবং নিজেও সেগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।
৬. জলাশয় থেকে সরে আসুন
নদী, হ্রদ, জলাধার বা সমুদ্রতীরে অবস্থান করলে তাৎক্ষণিক সেখান থেকে সরে যান। জল বিদ্যুৎ পরিবহনে সক্ষম। নৌযানে থাকলে দ্রুত তীরে ফিরে আসার চেষ্টা করুন।
৭. দলবদ্ধভাবে দূরত্ব রক্ষা করুন
দলগত ভ্রমণকালে বজ্রপাতের সময় কমপক্ষে ১০ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। এতে কারো উপর বজ্রপাত ঘটলেও অন্যদের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে।
বজ্রপাতের সময় কি কি করবেন না
১. মোবাইল ফোন ব্যবহার এড়িয়ে চলুন
বজ্রপাতের সময়, বিশেষ করে খোলা স্থানে মোবাইলে কথা বলা বিপজ্জনক। ফোন ব্যবহার না করে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।
২. গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকুন
ঝড় বা বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গাছ বজ্রপাতের লক্ষ্য হতে পারে, তাই সেখানে অবস্থান করবেন না।
৩. ধাতব বস্তু বহন করবেন না
ক্যাম্পিং গিয়ার, ধাতব ফ্রেমযুক্ত ব্যাগ বা ছাতার হাতলের মতো ধাতব জিনিস বজ্রপাতকে আকর্ষণ করতে পারে। এসব ব্যবহার বা বহন থেকে বিরত থাকুন।
৪. পানিতে থাকা বিপজ্জনক
সাঁতার বা নৌকায় থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে দ্রুত পানির বাইরে চলে আসুন এবং নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।
৫. একসাথে জটলা না করা
অনেক মানুষ একত্রে দাঁড়ালে বজ্রপাতে সবার ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ে। তাই ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখুন।
নিরাপদ থাকার আরও কিছু জরুরি টিপস
- হেডফোন খুলে রাখুন: বজ্রপাতের সময় ইয়ারফোন বা হেডফোন ব্যবহার করবেন না।
- লাইটনিং সেফ জোন তৈরি করুন: যদি গভীর জঙ্গলে থাকেন, একটি নিরাপদ স্থান খুঁজে নিন, মাথা নিচু করে আশ্রয় নিন।
- ৩০/৩০ নিয়ম মেনে চলুন: বজ্রপাতের আলো দেখার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে যদি বজ্রধ্বনি শুনতে পান, তাহলে বুঝবেন বজ্রপাত আপনার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে হচ্ছে। এমন অবস্থায় কমপক্ষে ৩০ মিনিট নিরাপদ স্থানে অপেক্ষা করুন।
- সতর্ক সংকেত লক্ষ্য করুন: বজ্রপাতের আগে কখনও কখনও বাতাসে বিদ্যুৎ অনুভূত হতে পারে বা শরীরে চুলকানি দেখা দিতে পারে। এগুলো বজ্রপাতের পূর্বাভাস—অবিলম্বে নিচু হয়ে বসুন।
ভ্রমণ জীবনের এক অপার আনন্দ, কিন্তু প্রকৃতির শক্তির সামনে আমাদের সতর্কতাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক বিপদকে অবহেলা করবেন না। সঠিক সিদ্ধান্ত ও সচেতনতাই আপনাকে নিরাপদ রাখবে, আর আপনার ভ্রমণকে করবে আরও সুন্দর ও স্মরণীয়।
প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি তার শক্তিকে সম্মান করুন। সচেতন থাকুন, নিরাপদ থাকুন এবং আনন্দময় ভ্রমণ করুন।
এখনো কোনো মন্তব্য নেই
প্রথম মন্তব্য করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!