
উত্তর-পূর্ব ভারতের নাম আগে শুনলেও এর বিস্তারিত জানা ছিল না। অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ—এই নয়টি রাজ্য নিয়ে গঠিত এই অঞ্চল। বাংলাদেশের সীমান্ত পার হলেই উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যগুলো আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক জটিলতার কারণে একসময় এই অঞ্চলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এখন সিকিম বাদে বাকি সব রাজ্যে ভ্রমণ করা যায়। তবে ২০১৮ সালের শেষ দিকে সিকিমও বাংলাদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
অরুণাচল সম্পর্কে কিছু তথ্য
ভারতে সূর্য সর্বপ্রথম উদয় হয় অরুণাচল প্রদেশে। যেহেতু এটি দেশের সর্বপূর্বের রাজ্য, তাই এটি একটি ভৌগোলিক সত্য। এই রাজ্যের আয়তন প্রায় ৮৪ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়ে কিছুটা বেশি। অরুণাচলের ৮২% এলাকা ঘন চিরহরিৎ বনে আবৃত। এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়—বছরে গড়ে তিন হাজার মিলিমিটারেরও বেশি। সমতল অঞ্চলে মৌসুমি আবহাওয়া থাকলেও উত্তরে যত যাওয়া যায়, ততই জলবায়ু আলপাইন বা পাহাড়ি ঠান্ডায় পরিণত হয়।
অরুণাচলের বেশিরভাগ এলাকাই পাহাড়ি, যেখানে সুউচ্চ শৃঙ্গ মেঘেরও ওপরে উঠে গেছে। শীতকালে এসব চূড়া সাদা বরফে ঢেকে যায়, বিশেষ করে সেলাপাস অঞ্চল। ১৭টি জেলা নিয়ে গঠিত এই রাজ্যের জনসংখ্যা ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী প্রায় ১৪ লাখ। এখানে ২৬টি প্রধান গোত্র ও শতাধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। জনসংখ্যার প্রায় ৩১% বিভিন্ন আদিবাসী ধর্মাবলম্বী, ৩৫% হিন্দু, ১৯% খ্রিস্টান এবং ১৩% বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। এখানে শিক্ষার হার ৬৭%।
অরুণাচলের রাজধানী ইটানগর, তবে পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হলো তাওয়াং জেলা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই শহর মেঘের দেশের মতো অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা।
যেভাবে ভ্রমণের শুরু
ভারত ভ্রমণের কথা মনে এলে বাংলাদেশীদের প্রথমেই কলকাতা, দার্জিলিং, দিল্লি, আগ্রা বা আজমির শরিফের নাম মনে পড়ে। কিন্তু ভারত সরকারের পর্যটন বিভাগের আমন্ত্রণ না পেলে ‘তাওয়াং’ নামের স্থানটির অস্তিত্বই জানতাম না!
অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণ
এক সকালে জার্নি প্লাসের প্রধান তৌফিক ভাইয়ের ফোন:
“আখতার, তাওয়াং যাবেন?”
“তাওয়াং আবার কোথায়?”
“অরুণাচল প্রদেশে, ভারতের উত্তর-পূর্বে। ৭ দিনের ট্রিপ। নাগাল্যান্ড, মিজোরাম বা আসামও ঘুরতে পারবেন।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম, যদিও তখন জ্বরে কাবু। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ধরা পড়ল—টাইফয়েড ও ডেঙ্গু! ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিলেও আমি মানিনি, কারণ ভ্রমণ বাতিল হয়ে যেতে পারে। বাড়িতে ইনজেকশন নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করলাম।
যাত্রা শুরু
দশম ইনজেকশন নেয়ার আধা ঘণ্টা পরই ঢাকা এয়ারপোর্টে রওনা দিলাম। প্রথমে কলকাতা, তারপর গৌহাটি। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে তাওয়াং। উত্তর-পূর্ব ভারতের গেটওয়ে গৌহাটিতে আমাদের স্বাগত জানাল স্থানীয় পর্যটন কর্তৃপক্ষ।
হেলিকপ্টারে প্রথম অভিজ্ঞতা
আমার উচ্চতাভীতি আছে, তাই ৩ আসনের ছোট হেলিকপ্টারের বদলে ২৩ আসনের রাশিয়ান MI-77 তে চড়ার ব্যবস্থা করা হলো। হেলিকপ্টার উঠলো—নিচে শুধু পাহাড়, আঁকাবাঁকা রাস্তা, মেঘের ভেলা। ঠিক সোয়া এক ঘণ্টা পর তাওয়াংয়ের মাটি স্পর্শ করলাম।
বরফশীতল তাওয়াং
হেলিকপ্টার থেকে নামতেই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা! তাপমাত্রা ৭°C, ডিসেম্বরে যা মাইনাসে নেমে যায়। গাইড লবসং টাসি এক কাপ রাইস ওয়াইন দিলেন—এক ঢোঁকে গলায় আগুন ছড়াল, শীত উধাও!
তাওয়াং মনাস্ট্রি: ৪০০ বছরের ইতিহাস
বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম পবিত্র স্থান এই মনাস্ট্রি। ১৬৮০ সালে দালাই লামা পঞ্চমের নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত। স্থানটি নির্বাচন করা হয়েছিল একটি ঘোড়ার সন্ধানে—যেখানে ঘোড়াটি দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই গড়ে উঠল এই মনাস্ট্রি। নাম ‘তাওয়াং’ অর্থ ‘পছন্দের ঘোড়া’।
উচ্চতার সঙ্গে যুদ্ধ
তাওয়াংয়ের উচ্চতা ১০,৫০০ থেকে ১৩,০০০ ফুট। অক্সিজেন কম, তাই হাঁটতে কষ্ট, মাথা ঘোরে। টাসির পরামর্শ—ধীরে চলো, গরম পানি খাও, গভীর শ্বাস নাও।
আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলা
তাওয়াংয়ে তখন ‘আন্তর্জাতিক ট্রাভেল মার্ট’-এর আয়োজন। বিশ্বের ৬০টি দেশের প্রতিনিধি, ভারতের সেলিব্রিটিদের উপস্থিতি। মুম্বাইয়ের অভিনেতা বিবেক ওবেরয়ও এসেছেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্থানীয় নৃত্য, পাহাড়ি খাবারের সমারোহ।
মাধুরী লেক ও জাং ফলস
বলিউডের গানে বিখ্যাত ‘মাধুরী লেক’ (আসল নাম শাংগেতসার লেক) দেখতে গেলাম। পাহাড়ি রাস্তা, নীল জলের হ্রদ—প্রকৃতি যেন ছবির মতো। এরপর জাং জলপ্রপাত—পাহাড়ের গা বেয়ে নামা সাদা ফেনিল জলধারা।
যুদ্ধস্মৃতিস্তম্ভ
১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ দেখলাম। সুবেদার জুগেন্দার সিং মাত্র ১৩ সৈন্য নিয়ে ৬০০ চীনা সৈন্যকে তিন দিন আটকে রেখেছিলেন। শহীদ হওয়ার পর তাঁকে ‘পরম বীরচক্র’ দেওয়া হয়।
বিদায় তাওয়াং
২২ অক্টোবর। হেলিকপ্টারে ফেরার পথে তাওয়াংয়ের ছোট ছোট ঘর, পাহাড়, সেলা পাসের দৃশ্য মনের গভীরে গেঁথে রইল। ৭ দিনের এই ভ্রমণ স্বপ্নের মতো কেটে গেল।
তাওয়াং সম্পর্কে কিছু তথ্য
- আয়তন: ২,০০০ বর্গকিলোমিটার
- জনসংখ্যা: ~৫০,০০০ (মূলত মনপা উপজাতি)
- শিক্ষার হার: ৬০%
- বিশেষত্ব: তিব্বতি সংস্কৃতি, বৌদ্ধ ধর্ম, অপরূপ প্রকৃতি
- তাওয়াং শুধু একটি স্থান নয়—একটি অনুভূতি, এক অজানা রোমাঞ্চের গল্প।
তাওয়াং এর দর্শনীয় স্থনসমূহ
তাওয়াংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করে, তেমনই এখানে রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। যেমন:
- তাওয়াং মঠ (বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম পবিত্র স্থান)
- মাধুরী লেক (শাংগেতসার লেক নামেও পরিচিত)
- নুরানাং জলপ্রপাত (জাং জলপ্রপাত নামে বিখ্যাত)
- যুদ্ধ স্মারক (ওয়ার মেমোরিয়াল)
- স্থানীয় হস্তশিল্পের প্রদর্শনী
যাতায়াত ব্যবস্থা
তাওয়াং যাওয়ার জন্য বিভিন্ন রুট রয়েছে। আপনার সুবিধা অনুযায়ী যেকোনো একটি বেছে নিন।
রুট ১: ঢাকা → কলকাতা → গুয়াহাটি → তাওয়াং
ঢাকা থেকে কলকাতা:
- বাসে: ১৪-১৫ ঘণ্টা (ভাড়া ≈ ১,৫০০ টাকা)
- ট্রেনে: ১২-১৩ ঘণ্টা (ভাড়া ≈ ৯৬০ টাকা থেকে)
- বিমানে: ৪০ মিনিট (ভাড়া ≈ ৬,০০০ টাকা)
কলকাতা থেকে গুয়াহাটি:
- বাসে: ২০-২২ ঘণ্টা (এসি বাস ≈ ১,০০০ টাকা)
- ট্রেনে: ২২-২৩ ঘণ্টা (ভাড়া ≈ ৮০০ টাকা)
- বিমানে: ১.১৫ ঘণ্টা (ভাড়া ≈ ১০,০০০ টাকা)
গুয়াহাটি থেকে তাওয়াং:
- বাসে: বমডিলা হয়ে প্রায় ২ দিন (ভাড়া ≈ ১,৫০০-২,০০০ টাকা)
- হেলিকপ্টারে: ১.১৫ ঘণ্টা (ভাড়া ≈ ৪,৫০০-৫,৫০০ টাকা/জন)
বিঃদ্রঃ ঢাকা থেকে গুয়াহাটি সরাসরি ফ্লাইট নেই, তবে জেট এয়ারওয়েজের কানেক্টিং ফ্লাইটে যাওয়া যায় (রিটার্ন টিকেট ≈ ২১,০০০ টাকা)।
রুট ২: ঢাকা → তামাবিল → শিলং → গুয়াহাটি → তাওয়াং
ঢাকা থেকে তামাবিল:
- সিলেট হয়ে বাস/জিপে ≈ ৬০০-১,০০০ টাকা
তামাবিল থেকে শিলং:
- বর্ডার পার করে বাস/জিপ ≈ ৫০০-৮০০ টাকা
- শিলং থেকে গুয়াহাটি:
- বাসে ≈ ১,৫০০-২,০০০ টাকা
- গুয়াহাটি থেকে তাওয়াং: উপরের মতো।
থাকার ব্যবস্থা
যাত্রাপথে কলকাতা, শিলং বা গুয়াহাটিতে থাকার প্রয়োজন হতে পারে। তাওয়াংয়ে বাজেট অনুযায়ী হোটেল পাবেন:
- কলকাতা: গ্র্যান্ড হায়াত, পিয়ারলেস ইন, মনোটেল, ডি.কে. ইন্টারন্যাশনাল
- গুয়াহাটি: হোটেল ব্রহ্মপুত্র অশোক, গেটওয়ে, রেইনস ইন
- শিলং: পোলো টাওয়ার, অ্যালপাইন কন্টিনেন্টাল, পাইনউড
- তাওয়াং: সংগার লজ, তাওয়াং লজ, জ্যাক্স হোটেল (ভাড়া ≈ ৩,০০০-৪,০০০ টাকা/রাত)
পরামর্শ: বুকিংয়ের আগে অনলাইনে রিভিউ দেখে নিন।
এখনো কোনো মন্তব্য নেই
প্রথম মন্তব্য করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!